জাতির সংবাদ ডটকম।।
ভাষা সৈনিক ও প্রবীণ সাংবাদিক অধ্যাপক আব্দুল গফুর শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বেলা ২টা ৪৩ মিনিটে পুরান ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর।
মহান ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ভাষা সৈনিক , দৈনিক ইনকিলাবের ফিচার সম্পাদক, একুশে পদক প্রাপ্ত অধ্যাপক আব্দুল গফুরকে ফুলের শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলাদেশ সিভিল রাইটস্ সোসাইটির চেয়ারম্যান জাকির হোসেন ও নির্বাহী পরিচালক শেখ মোহাম্মদ তাজুল ইসলামসহ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
শুক্রবার রাত ৯টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে অধ্যাপক গফুরের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করার কথা রয়েছে।
অধ্যাপক আবদুল গফুর ১৯২৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজবাড়ীর দাদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই তমদ্দুনস মজলিস বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনও শুরু করে। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠালাভ করলে তাতে যোগ দিয়ে ছাত্রাবস্থায় অধ্যাপক আবদুল গফুর এই আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে ভাষার আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকা। সেই পত্রিকার শুরুতে সম্পাদক ছিলেন কথাসাহিত্যিক শাহেদ আলী আর সহকারী সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক আবদুল গফুর। পরে শাহেদ আলী সরকারি চাকরি নিয়ে ঢাকার বাইরে চলে গেলে পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন তিনি।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে তিনি সৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে পরের দিন সৈনিক পত্রিকার তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল তার সম্পাদনাতেই। এ সব কারণে তৎকালীন সরকার তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। তাকে এবং তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেমকে গ্রেপ্তার করার জন্য আজিমপুরের সৈনিক পত্রিকার অফিস ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ ঘেরাও করে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পরে বেশ কয়েক মাস দেশের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকতে হয়। ভাষা আন্দোলনের সফলতার পথ ধরেই পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয় এবং বাংলা ভাষা রাষ্ট্রাভাষার মর্যাদা পায়। পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনই ছিল এই ভাষা আন্দোলনের সফলতা থেকে উৎসারিত প্রেরণা-শক্তি দ্বারা সঞ্চালিত। যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে।
ভাষা আন্দোলনের পরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সরে গিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন অধ্যাপক আবদুল গফুর। একপর্যায়ে ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করার পর প্রথমে চট্টগ্রাম জেলা সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি নেন। পরে সরকারি চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতা পেশা বেছে নেন। তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে (১৯৬৩-১৯৭০) ও ঢাকার আবুজর গিফারী কলেজে (১৯৭২-১৯৭৯) অধ্যাপনা করেন ১৭ বছর। স্বাধীনতার আগে ও পরে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের পূর্বসূরি সংস্থা দারুল উলুম (ইসলামিক একাডেমি)-এর সুপারিনটেন্ডেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রকাশনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যাপক গফুরের সাংবাদিকতার শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে পাক্ষিক জিন্দেগীতে। এরপর সাপ্তাহিক সৈনিক (১৯৪৮-১৯৫৬) পত্রিকায় প্রথমে সহসম্পাদক এবং পরবর্তীতে সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে দৈনিক মিল্লাত এবং ১৯৫৮ সালে দৈনিক নাজাত-এ সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দৈনিক আজাদ-এর বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর ইংরেজি ডেইলি পিপল (১৯৭২-১৯৭৫)-এ এবং দৈনিক দেশ (১৯৭৯ – ১৯৮০)-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ফিচার সম্পাদক হিসেবে তিনি কর্মরত ছিলেন।
অধ্যাপক আবদুল গফুর বাংলা ও ইংরেজিতে অনেক বই লিখেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ইসলাম, বিপ্লবী উমর, কর্মবীর সোলায়মান, Social Welfare, Social Services,, কোরআনি সমাজের রূপরেখা, ইসলাম কি এ যুগে অচল, ইসলামের জীবন দৃষ্টি, রমজানের সাধনা, ইসলামের রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, শাশ্বত নবী অন্যতম। তার রচিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, খোদার রাজ্য, স্বাধীনতার গল্প শোনো ও আসমান জমিনের মালিক। এ ছাড়াও তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ আমার কালের কথা-১ প্রকাশিত হয়েছে। এখনও অনেক লেখাই অপ্রকাশিত রয়ে গেছে।
অধ্যাপক গফুরের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ সিভিল রাইটস্ সোসাইটি-বিসিআরএস।
তারা শোকবাণীতে অধ্যাপক গফুরের মৃত্যুতে জাতি এক সূর্যসন্তানকে হারালো উল্লেখ করে বলেন, তার এ স্থান পূরণ হওয়ার নয়। তারা অধ্যাপক আবদুল গফুরের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।