
দিলীপ কুমার দাস নিজস্ব প্রতিবেদক।
বিনামূল্যে এক লাখ ১৮ হাজার মানুষকে ছানি অস্ত্রোপচার সেবা দিয়েছে ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত একটি হাসপাতাল। সংখ্যাটি আপনার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তবে এই অবিশ্বাস্য কাজটিই সম্পাদন করেছে ডা. মুক্তাদির চক্ষু হাসপাতাল।
অধ্যাপক ডা. এ কে এম মুক্তাদির হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর অবস্থান ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামে। এখানে নৈসর্গিক পরিবেশে সেবা নিতে আসছেন দূর-দূরান্তের মানুষ। ২০০৪ সালে এ গ্রামেই পাঁচ একর জমিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় হাসপাতালটি। আধুনিক ও উন্নতমানের চক্ষু চিকিৎসাসেবার কারণে সুনাম কুড়িয়েছে হাসপাতালটি। ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা এলাকার চক্ষুরোগীদের জন্য এটি এখন এক নির্ভরযোগ্য হাসপাতাল।
এ সময় একটি আধুনিক চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে শুরু করেন ডা. মুক্তাদির। তার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসেন তার স্ত্রী গাইনি চিকিৎসক মাহমুদা খাতুন। নিজের পেনশনের সব অর্থ তুলে দেন স্বামীর হাতে। ২০০৪ সালে পাঁচ একর জমিতে ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন ডা. মুক্তাদির। বর্তমানে এটি ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। স্ত্রীর পাশাপাশি তার এ মহতী কাজে যুক্ত হয়েছেন তাদের চিকিৎসক সন্তানরাও।
ডা. মুক্তাদির চক্ষু হাসপাতালে চোখের ছানি অপারেশন (লেন্স প্রতিস্থাপন), নেত্রনালির চিকিৎসা, চোখের মাংস বৃদ্ধি, গ্লুকোমা, চোখ প্রতিস্থাপন, চোখের গুটি, বাঁকা চোখ, চোখের লেজারসহ বিভিন্ন সাধারণ ও জটিল রোগের চিকিৎসা প্রদান করা হয়। রোগীদের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। ২০০৪ সাল থেকে এই হাসপাতালে নামমাত্র মূল্যে ছানি অপারেশন সেবা পেয়েছেন ৫৭ হাজার ৫৩০ জন। নেত্রনালির চিকিৎসা নিয়েছেন ৪ হাজার ৬১৫ ব্যক্তি। চোখ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ৪১৫ জনের। এখানে বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩ লাখ ২৬ হাজার ৬১৫ জন।
বর্তমানে ডা. মুক্তাদির চক্ষু হাসপাতালটি চারতলা ভবনের। পুরো হাসপাতালে রয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মনোরম পরিবেশ হাসপাতালজুড়ে। বাইরে সবুজে-ফুলে সজ্জিত, ভেতরে তকতকে। হাসপাতালের সামনেই মিনি চিড়িয়াখানায় রয়েছে হরিণসহ বিভিন্ন পশু। স্টাফদের বিনয়ী আচরণে মুগ্ধ হন দূর-দূরান্তের রোগীরা। সপ্তাহের সাত দিনই হাসপাতালের বহির্বিভাগ চালু থাকে। দুইজন চিকিৎসক বহির্বিভাগে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সেবা দেন। আর আন্তঃবিভাগে দু’জন চিকিৎসক সেবা দেন। শুক্র ও শনিবার হাসপাতালটিতে সেবা দেন ডা. মুক্তাদির নিজেই। গত ১ জানুয়ারি ডাঃ মুক্তাদির হাসপাতালে মুক্তাদির স্মৃতি যাদুঘর উদ্বোধন করেছেন। যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেখে অভিভূত হবে।
ডা. মুক্তাদির মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেন। মুক্তাদির দম্পতির চার সন্তানই চিকিৎসক। এর মধ্যে ডা. মুশফিয়া রিফাত (গাইনি), ডা. মালিহা শারমিন (চক্ষু), ডা. মারুফ ওয়াহিদ (চক্ষু) ও ডা. মাশরুফ ওয়াহিদ (চক্ষু) চিকিৎসক। মেয়েদের স্বামী ও ছেলেদের স্ত্রীরাও চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।
প্রতি বছর শুধু নামমাত্র রেজিস্ট্রেশন ফিতে এই হাসপাতালে ছানি অপারেশনের ক্যাম্প করা হয়। দেশের প্রায় সব খ্যাতনামা চক্ষু চিকিৎসক এই হাসপাতালে এসে দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেন। প্রত্যন্ত এলাকায় এমন চিকিৎসাসেবার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ডা. মুক্তাদির ২০১৪ সালে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছ থেকেও পুরস্কার পান। চিকিৎসাশাস্ত্র ও সমাজসেবার জন্য তিনি ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে আরও ১১টি পুরস্কার পেয়েছেন।
চিকিৎসা পেশার পাশাপাশি ডা. মুক্তাদির একজন শিল্পসাধকও। বাংলাদেশ বেতারে ১৯৭২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ইলেকট্রিক হাওয়াইন গিটার পরিবেশন করে আসছেন তিনি।
ডা. মুক্তাদির বলেন, গ্রামের মানুষের সামর্থ্য নেই দূরে গিয়ে চিকিৎসা করানোর। তাই মানুষকে আধুনিক সেবা পৌঁছে দিতে প্রত্যন্ত গ্রামে তিনি হাসপাতাল গড়েছেন। ভালো সেবার জন্য এ দেশের রোগীরা ভারতে ছুটে যায়। বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা রোধ করে ভালো সেবা পেলে যে মানুষ প্রত্যন্ত গ্রামেও ছুটে যায়, সেই নজির তার হাসপাতাল সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। গৌরীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম মিন্টু বলেন, এ অঞ্চলের মানুষের জন্য আশীর্বাদ ডা. মুক্তাদির চক্ষু হাসপাতাল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই মানুষ সেবা নিতে আসে এখানে। আমরা এই হাসপাতালের কার্যক্রমে গর্বিত।