আইন শক্তিশালীকরণে তামাক কোম্পানির মতামত নেয়া সংবিধান, জনস্বার্থ ও জনস্বাস্থ্য বিরোধী – বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট

শনিবার, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৫

জাতির সংবাদ ডটকম।।

 

তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে দেশে বিদ্যমান আইনটি শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এমতাবস্থায়, তামাক কোম্পানির সাথে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর সভা পুরোপুরি জনস্বার্থবিরোধী। সম্প্রতি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তামাক কোম্পানির সাথে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে একটি সভা আয়োজন করতে যাচ্ছে। সভাটিতে দেশ-বিদেশের তামাক ব্যবসার সাথে সম্পৃক্তদের অংশীজন হিসেবে উল্লেখ করে মতামত প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং সরকারের জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন প্রচেষ্টার পথে অন্তরায়। জনস্বার্থ বিরোধী এবং জনস্বাস্থ্যের পরিপন্থী এধরণের কর্মসূচির আয়োজনে বাংলাদেশ তামাক বিরেধী জোট উদ্বিগ্ন এবং উৎকন্ঠিত। বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট এর পক্ষ থেকে অনতিবিলম্বে তামাক কোম্পানির সাথে এধরণের বৈঠক প্রত্যাহারের আহ্বান জানাই।

 

এইকথা সর্বজনস্বীকৃত যে, তামাক কোম্পানির মূল লক্ষ্য জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করে মুনাফা অর্জন, আর সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা। আমরা এনবিআরকে জানাতে চাই, পরষ্পর বিরোধী উদ্দেশ্য নিয়ে কোন গোষ্ঠী অংশীজন হতে পারে না। বিগত দিনেও তামাক কোম্পানিগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। এমতাবস্থায় নতুন করে আবার তামাক কোম্পানিকে নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা মানে দুর্বল নীতি প্রণয়নের সুযোগ তৈরি করে দেয়া এবং জনগণকে আরও স্বাস্থ্যঝুঁকির দিকে ঠেলে দেওয়া। সুতরাং তামাক কোম্পানিকে কোনোভাবেই জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার অংশীজন হিসেবে গণ্য করা যায় না।

 

আরও উল্লেখ করতে চাই, স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি Framework Convention on Tobacco Control (FCTC)-এফসিটিসি -এর আর্টিকেল ৫.৩ অনুযায়ী, অংশীদার রাষ্ট্রসমূহের তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতি ও তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিতে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তামাক কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এফসিটিসি -এর স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণে নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পাশাপাশি এই কনভেনশনের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশরও সেই লক্ষ্যে কাজ করা উচিত। কিন্তু আমরা উদ্বিগ্নতার সাথে লক্ষ্য করছি সারাবিশ্বে যেখানে তামাকের ব্যবহার হ্রাসে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে সেখানে আমাদের দেশে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তামাক কোম্পানির ব্যবসা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

 

বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা অংশে ১৮(১) অনুচ্ছেদে জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলা হয়েছে। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন ও লক্ষ্য পূরণে যেখানে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ জরুরি সেখানে কেবলমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থে তামাক কোম্পানিকে এই ধরণের সুযোগ দেয়া এবং বিদ্যমান আইনকে দূর্বল করতে তামাক কোম্পানির মতামত নেয়া এদেশের সংবিধান, জনস্বার্থ ও জনস্বাস্থ্যের পরিপন্থী।

 

সরকারের মূল দায়িত্ব জনগণের স্বার্থ এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা করা। জনগণ যদি অসুস্থ থাকে সে রাষ্ট্রের উন্নয়ন কোনভাবেই সম্ভব নয়। সিগারেটের মতো ক্ষতিকর পণ্যের প্রসারে এদেশের জনস্বাস্থ্য তথা যুব সমাজ ধ্বংস হবে এবং পরিবেশসহ অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সরকারের কোনভাবেই উচিত হবে না সিগারেট কোম্পানির কাছ থেকে মতামত নিয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটিকে আরও দূর্বল করার সুযোগ তৈরি করে দেয়া। ইতিমধ্যেই আইন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতার কারণে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি শক্তিশালী হওয়ার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিগারেট কোম্পানির প্রতি নরম মনোভাবের কারণে দেশের ফসলী জমিতে তামাক চাষের পরিমাণ দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে। যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো সংবিধান অনুসারে তামাক নিয়ন্ত্রণকে জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছে না । বরং জনস্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করে তারা সিগারেট কোম্পানির বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে।

 

আমরা এনবিআরকে জানাতে চাই, উন্নত বিশ্বে জনসাধারণের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়ে যাওয়ায়, আইনের প্রয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোর হওয়ায় তারা এদেশে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের অপচেষ্টায় লিপ্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের সিগারেটের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মূলত দুইটি বিদেশী কোম্পানি। তাদের মূল উদ্দেশ্য এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণসমাজকে টারগেট করে ধূমপানে আসক্ত করা। যার মাধ্যমে তারা এদেশের জনস্বাস্থ্যকে ধ্বংস করতে চায় । কেবলমাত্র মুনাফার লোভে বিদেশী সিগারেট কোম্পানিগুলো এদেশের জনস্বাস্থ্যকে বিপন্ন করছে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশে দেশীয় তামাক কোম্পানিগুলো তাদের তামাক ব্যবসা গুটিয়ৈ এনে অন্য ব্যবসায় স্থানান্তরিত হয়েছে। সুযোগসন্ধানী বিদেশী কোম্পানিগুলো আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে তাদের নতুন বাজার দখল করার চেষ্টা করছে। কাজেই রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অবশ্যই অর্থ প্রয়োজন তবে ক্ষতিকর এই শিল্পের বিস্তার ঘটিয়ে সেটা কাম্য হতে পারে না।

 

বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে আহ্বান জানাই, বাংলাদেশ সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থা হিসেবে দেশের জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে তামাক কোম্পানির সঙ্গে “ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর খসড়া, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের প্রভাব, অবৈধভাবে আমদানিকৃত সিগারেটের ব্যবহার হ্রাস এবং এ খাতের রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত” বৈঠক অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করা হোক। সেইসাথে দেশের কল্যাণে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করবে এমন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি ক্ষতিকর তামাক কোম্পানিগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের দাবি জানাই।