নিজস্ব প্রতিবেদক :: বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (বিএইচবিএফসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে এখনো বহাল তবিয়তে আছেন পতিত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক কর্মকর্তা। সরকারি চাকরিজীবী হয়েও তারা প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। বিএইচবিএফসির টাকায় করেছেন টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কবর জিয়ারত থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণ ও বঙ্গবন্ধুর নামে তৈরি করেছেন মুজিব বুক কর্ণার। শেখ কামাল, শেখ রাসেল এমন কোন ব্যাক্তি নেই যে তাদের জন্মদিন মৃত্যু দিন পালন করেননি এই কর্মকর্তারা। আর এ সব কিছুই করেছেন বিএইচবিএফসি তথা সরকারি অর্থে। যা নিয়ে ছিল শুরু থেকেই বিতর্ক। আর অনেকের মনে ছিলো চাপা ক্ষোভ। নিজেদের চেয়ার আকড়ে ধরে রাখতেই এতোদিন এগুলো করে এসেছেন। এখন খোলস পালটিয়ে ধরেছে নতুন ভোল।
৫ই আগস্ট বিপ্লবের পর সারা বাংলাদেশে যখন আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের বিভিন্ন দপ্তর থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সেখানে এই কর্মকর্তারা এখনো স্বপদে বহাল। যার ফলে এই দোসররা এখন কৌশলে বিএইচবিএফসিকে নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের পথে। আর বর্তমান অন্তর্বতী সরকারকে নানা কায়দায় করছেন বিতর্ক।
খোঁজ নিয়ে যানা যায়, স্বৈরাচার সরকারের নিয়োগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন’র (বিএইচবিএফসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে রয়েছেন মো.আব্দুল মান্নান। এর আগে রাকাবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই পদন্নোতি, ঋণ ও বদলি বাণিজ্যসহ ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসলে এস আলম গ্রুপের আশির্বাদপুষ্ট এ কর্মকর্তাকে আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের সুপারিশে নয় মাসের মাসের মাথায় বিএইচবিএফসিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেন তৎকালীন সরকার। এর পর থেকেই তিনি রয়েছেন বিএইচবিএফসিতে। এখানে এসেই তিনি আওয়ামী লীগ সরকারকে তথা এস আলম গ্রুপকে খুশি রাখতে হাতে নেন নানা প্রকল্প।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিএইচবিএফসির ইতিহাসে এই প্রথম প্রায় দীর্ঘ সাত মাস ঋণ গ্রহীতারা চেক পাচ্ছে না। ঋণ মঞ্জুরী হলেও হাজার হাজার ঋণ গ্রহীতার চেক বিতরণ হচ্ছে না। যার ফলে গ্রাহকরা একদিকে ঋণের টাকা পাচ্ছে না। অপরদিকে মাসের পর মাস সুদ গুনতে হচ্ছে। অথচ বিএইচবিএফসি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের কয়েক শত কোটি টাকার এফডি আর করা এস আলম গ্রুপের মালিকানা ব্যাংকে। যার কোন হদিস নেই বর্তমানে।
খোঁজ নিয়ে আরো যানা যায়, গ্রাহকদেরকে ঋণ দেওয়ার জন্য ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয় আইএসডিপি প্রজেক্টে। অথচ ঋণ বিতরণ না করে গেলো নভেম্বর ১৮ তারিখে হোটেল শেরাটনে এ প্রজেক্টের জমকালো অনুষ্ঠান করে অর্ধ কোটি টাকার উপরে খরচ করে। শত শত কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুরি করেও বিতরণ করতে দীর্ঘ সাত মাস গড়ি মসি। যার ফলে ভোগান্তিতে ঋণ গ্রহীতা। তারা অনেকে একটি চেক পেয়ে বসে আছে নির্মাণ করতে পারছে না তার স্বপ্নের বাড়টি। গুনতে হচ্ছে মাসের পর মাস সুদ।
এছাড়া ঢাকায় এ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থাকা সত্ত্বেও ৪০ জনের বহর নিয়ে কক্সবাজারে ওয়ার্কশপের নামে আনন্দ ভ্রমনে গেছে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মান্নান গং এবং তাদের পরিবার।
আরো অভিযোগ রয়েছে এ কর্মকর্তার নামে, আব্দুল মান্নান নিজস্ব গাড়ির জন্য মেইনটেনেন্স খরচ নিলেও তিনি তার চলাফেরার জন্য ব্যাবহার করেন অফিসের দুটি গাড়ি। মান্নানের ছেলে মেয়ের লেখাপড়া শেষ। তবুও নিয়েছেন শিক্ষা ভাতা। অতিরিক্ত এ শিক্ষা ভাতা নেওয়ার কারণে রয়েছে অডিট আপত্তি। তিনি নিয়মিত আপ্যায়ন ভাতা নিজ একাউন্টে নিলেও তার আর্পায়ন খরচ বহন করে অফিস থেকে। এছাড়া গেলো দুই বছরে তিনি অফিসিয়াল ট্যুরের কথা বলে তার পরিবারের সকলকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারাদেশ। এমনকি জনশ্রুতি আছে তিনি তার ছেলের বিয়ে দিয়েছেন অফিসের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে। কমার্শিয়াল অডিটে তার বিরুদ্ধে ৫২ কোটি টাকার আপত্তি রয়েছে দুদুকে। এছাড়া সাবেক চেয়ারম্যান সেলিম আহমেদকে কে দুই কোটি টাকা ফ্ল্যাট কেনার জন্য দেয়া হয়েছে বিএইবিএফসি থেকে। যার কোন হদিস নাই।
একাধিক বিএনপি নেতা জানান, শুধু জাতীয় দিবসই নয় আওয়ামী সরকারকে খুশি রাখতে এই মান্নান গংরা শেখ মুজিবুর রহমানকে পুঁজি করে তার পরিবারের প্রতিটি ব্যক্তির মৃত্যুবার্ষিকী ঢাকঢোল পিটিয়ে অফিস খরচে পালন করতো। সরকারি কর্ম ঘন্টা বন্ধ রেখে জাতীয় দিবস বাদেও শেখ পরিবারের শেখ কামাল শেখ রাসেল শেখ রেহানা সহ তাদের পরিবারের সকলের জন্মদিন মৃত্যুদিন অফিস খরচে ঘটা করে পালন করেছে। লাভজনক এ প্রতিষ্ঠানকে এস আলম গ্রুপের আশির্বাদপুষ্ট চেয়ারম্যান ও ব্যাবস্থাপনা পরিচালক দেউলিয়ার পথে নিয়ে যাচ্ছে। চেয়ারম্যান বিদায় হলেও রয়ে গেছে ফ্যাসিস্ট ব্যাবস্থাপনা পরিচালক ও তার কয়েকজন আস্থাভাজন অনুসারী জিএম খায়রুল ইসলাম গংরা। যারা কিনা এখন বিএইচবিএফসি কে তাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান বানিয়ে রেখেছেন। যার ফলে ইচ্ছা স্বাধীন যা খুশি করছেন। বিএইচবিএফসিকে দেউলিয়ার পথে নিয়ে যাচ্ছেন। আর বর্তমান অন্তবর্তী সরকারকে বিপাকে ফেলার পায়তারায় মেতেছে। বিএইচবিএফসি’র নিজস্ব তহবিল থাকা স্বত্ত্বেও ঋণ গ্রহীতারা টাকা পাচ্ছেন না। অফিসের খরচে এমডির ছেলে ও ছেলে বৌর হানিমুন হয়েছে কক্সবাজার। তার সাথে ছিল জিএম খায়রুল ইসলাম। এ কর্মকর্তা যেখানেই ট্যুরে যেতেন সেখানেই কর্মকর্তাদের বাধ্য করতেন দামী দামী উপহার তাকে দিতে। ৬৪ টি অফিস ডেকোরেশন এর নামে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছে জি এম খাইরুল।
একাধিক ঋণ গ্রহীতা অভিযোগ করে বলেন, গ্রাহকরা ঋণের টাকা পাচ্ছে না। অথচ আমরা বিভিন্নভাবে জানতে পারি কক্সবাজারে ফাইভ স্টার হোটেলে প্রোগ্রাম করছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অফিসিয়াল এ প্রোগ্রামে তিনি তার পরিবারের সকলকে নিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয় অন্য কয়েকজন কর্মকর্তাদের খুশি রাখতে তাদের পরিবারের ব্যাক্তিদের সাথে যাওয়ার সুযোগ দেন। এতে এ প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকার অপচয় করা হয়েছে। সকল ব্যাক্তি কক্সবাজারে বিমানে যাতায়াত ও ফাইভ স্টার হোটেলে পাচ দিন থাকা খাওয়ার সব খরচ অফিসিয়াল ভাবে বহন করে। যার খরচ আনুমানিক প্রায় কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে যানা যায়, হাউজ বিল্ডিং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে এই পদের অপব্যবহার করেছেন বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউ লাউঞ্জ ব্যবহারে। তিনি গত ২১ নভেম্বর একটি চিঠি জারি করেন প্রশাসন বিভাগ উপমাবস্থাপক। চিঠিতে দেখা যায় আব্দুল মান্নান তার স্ত্রী কন্যা শাশুড়িকে নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে গমন করবেন ২২ নভেম্বর দুপুর ২ টায় ইউ এস বাংলা এয়ারলাইন্সে। ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারে এমন চিঠি দিয়ে পরিবারের সবাই ব্যাবহার করা ক্ষমতার অপব্যবহার মাত্র।
যুক্ত ফোরামের প্রধান সমন্বয়ক চাষী মামুন সাংবাদিকদের বলেন, অন্তবর্তী সরকার ১০০ দিন পার করলেও সচিবালায় ও অন্যান্য সরকারি দপ্তর থেকে আওয়ামী লীগের দোসরদের সরাতে পারেনি। যে আশা নিয়ে ছাত্র জনতার গণঅভুত্থানে যে দেশ আমরা পেয়েছি তাঁর কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এ সকল কর্মকর্তাদের কারণে ।
তবে এসব বিষয়ে বিএইচবিএফসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মান্নানের অফিসিয়াল টেলিফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।