জাতির সংবাদ ডটকম।।
সরকারের নিয়ন্ত্রণ তথা পুলিশি পাহারা থাকা অবস্থায় দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানায় লুটপাটে ৩৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক ড. মাহমুদুর রহমান। তবে বর্তমানে প্রেসের কিছু না থাকলেও বিকল্প ব্যবস্থাপনায় অন্য প্রেস থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই আমার দেশ পত্রিকা ছাপা হবে বলে ঘোষণা দেন তিনি। এজন্য অফিস সেটাপ সহ অন্যান্য প্রস্তুতির কথা জানান মাহমুদুর রহমান।
আজ শুক্রবার সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে আমার দেশ পত্রিকার পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক ড. মাহমুদুর রহমান এসব কথা জানান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের দীর্ঘ ১৬ বছরের জালিম-ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। এক দানবীয় সরকারের পতন হওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা মুক্ত পরিবেশে এই মতবিনিময় ও প্রশ্নোত্তর পর্বে উপস্থিত হতে পেরেছি-এটা আনন্দের অনুভূতি। আর বেদনার অনুভূতি হলো- আমার সাংস্কৃতিক এবং বুদ্ধিভিত্তিক লড়াইয়ের যে হাতিয়ার আমাদের দেশ পত্রিকার ছাপাখানাকে বিগত ফ্যাসিবাদি সরকার গত ১১ বছর ধরে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। দুদিন আগে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে একজন ম্যাজিস্ট্রেট ও দুইজন ওসি তালা ভেঙ্গে আমাকে বুঝিয়ে দিতে গিয়েছিলেন। সেখানে ঢুকেই আমরা দেখতে পেয়েছি, প্রেসের কিছুই অবশিষ্ট নাই। এমনকি ইলেক্ট্রিক প্যানেল পর্যন্ত টুকরো টুকরো করে নিয়ে গেছে। শুধুমাত্র ভাঙ্গা সম্ভব না হওয়ায় দুটি মেশিনের খন্ডাংশ আছে। সব কিছু টুকরো টুকরো করে নিয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল শেখ হাসিনা আমার দেশ সম্পাদক তথা আামাকে টুকরো টুকরো না করার জিঘাংসা মিটিয়েছে, প্রেসকে টুকরো টুকরো করেছে। এটাই ফ্যাসিবাদের চরিত্র। সরকারি প্রতিনিধিরা বাস্তব অবস্থা দেখেছেন এবং ত মিডিয়ার সামনে প্রেসের ক্ষতির কথা স্বীকার করেছেন।
আমার দেশ নিয়ে পরিকল্পনার কথা জানিয়ে সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, প্রেসতো নাই, শুধু জমি আছে। নতুন একটা প্রেস করতে প্রথমত টাকা দরকার-ওই টাকা আমার নেই। আমাদের যারা পরিচালক তাদের কারও অত টাকা নেই এবং আমরা কর্পোরেট মিডিয়া না। বাংলাদেশে একমাত্র আমার দেশ কোন কর্পোরেট মিডিয়া না। আমার দেশ আমরা নিজেরা কষ্ট করে চালাই। অন্যরা কর্পোরেট স্বার্থে পত্রিকা চালায়, আমার সেই স্বার্থ নেই। আমি অবসরপ্রাপ্ত হিসেবে লেখালেখি করার জন্যই পত্রিকা চালাতে চাই। দ্বিতীয়ত প্রেস করতে সময় লাগবে। কিন্তু আমি মনে করি, বাংলাদেশ বর্তমানে যেই ষড়যন্ত্রের মুখে দাঁিড়য়ে আছে সেই ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় শক্তিশালী মিডিয়া দরকার। যে মিডিয়া কোন কর্পোরেট স্বার্থে নয়, কোন দলের স্বার্থে নয় বাংলাদেশের জন্য লড়বে। জনগণ ও সাংবাদিকদের অধিকারের জন্য লড়বে। সেইজন্য আমরা অন্য প্রেস থেকে ছাপার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দুই তিনটি প্রেসের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তাও মোটামুটি ফাইনাল হয়েছে, ইনশাআল্লাহ ছাপানোর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু ছাপানোর আগে মেটার তৈরি করতে তো অফিস দরকার। অফিসে অন্তত ১০০ কম্পিউটারসহ আধুনিক টেকনোলজির জিনিস দরকার। সেটাও সেটাপ করতে হবে। সাংবাদিকদের দরকার। আমাদের মধ্যে যারা সাংবাদিকরা আছেন, তারাতো কাজ করতে আসবেন, তাদেরকে সেবার মানসিকতা নিয়ে আসতে হবে। ধরে নেবেন যে, তারা একবছর আমার দেশের সঙ্গে লড়াই করবেন। তাদের মেধা অনুযায়ী যে বেতন ভাতা দেয়া উচিত সেটা দেয়ার সক্ষমতা আমাদের নেই। সেটাও আমাদের সীমাবদ্ধতা। তবে আমার ধারণা আমার সহকর্মীরা আমার সঙ্গে লড়াই করতে রাজি হবেন। সেটাও বড় সমস্যা না, বড় সমস্যা হলো অফিস সেটাপ করা। সেজন্য আমরা অফিস খুঁজছি। তবে একটি সুসংবাদ হলো-যতই কষ্ট হোক, ডিসেম্বর মাসের মধ্যে আমার দেশ পত্রিকা আপনাদের মাঝে তুলে দিতে পারবো। আমার দেশ আবার আসবে, স্বাধীনতার কথা বলবে. ভারতীয় সাম্প্রসারণবাদ ভারতীয় হেজেমনির বিরুদ্ধে কথা বলবে। বাংলাদেশের লুটেরা ব্যবসায়ী, গুম সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলবে আমার দেশ। মানবাধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে আওয়াজ তুলবে আমার দেশ। আপনারা সহযোগিতা করুন। সরকারেরও সহযোগিতা লাগবে। আইনি বেড়াজালে, আমলাতান্ত্রিক বেড়াজালে যেন আমার দেশকে পড়তে না হয়।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালের অক্টোবরে আমার দেশ অফিস সামগ্রী অন্যত্র সরিয়ে নেয়া সিদ্ধান্ত হলে, সেই সময় অফিসের সবকিছু আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। জেল খানায় বসে আমি সেই খবর শুনত পেয়েছিলাম। তখন আমি আমার দেশ অফিসের পরিবর্তে সহকর্মীদের কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা-তা জানতে চেয়েছিলাম। আল্লাহর রহমতে তারা নিরাপদে ছিলেন-এটাই আমার কাছে আনন্দের সংবাদ ছিল। ফ্যাসিবাদের একটি চরিত্র হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, তৎকালীন একজন মন্ত্রী- সম্ভবত আমির হোসেন আমু আমাদেশের পোড়া অফিস ভিজিট করতে গিয়ে বলেছিলেন, ইন্সুরেন্সের টাকা পেতে আমার দেশ কর্তৃপক্ষই এটা আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে। আসলে চোররাতো অন্যদের চোরই মনে করে। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, আমার দেশের কোন ইন্সুরেন্সই করা ছিল না, তাহলে টাকা পাবে কোত্থেকে।
মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মাহমুদুর রহমান বলেন, আমার দেশ পুড়িয়ে দেয়া, পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়া, শতশত সাংবাদিক-কর্মচারীর বেকার হওয়া, আমাকে জেলে নেয়া, রিমান্ডে নির্যাতন ও হত্যা চেষ্টা, র্যাবের আয়না ঘরে নেয়া এবং থানায় আমাকের হত্যা চেষ্টা এবং আমার দেশ ছাপাখানা সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় লুটপাট করে নেয়া হলো-এতগুলো ঘটনা ঘটলেও কোন মিডিয়ায় সমালোচনা শোনা যায়নি। কোন সম্পাদকতো কথা বলেননি। যেসব সম্পাদক বাক স্বাধীনতার কথা বলেন, যারা নির্লজ্জভাবে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে সমর্থন দিয়েছেন, এসব বড় বড় কোন সম্পাদকের মুখে শুনিনাই যে, আমারদেশের ওপর এত জুলুম মেনে নেয়া যায় না। আমার দেশের সার্কুলেশন এক নম্বরে নাকি প্রথম আলো এক নম্বরে ছিল, এটা নিয়ে বিতর্ক ছিল-সেই আমার দেশকে পত্রিকাকে মালিকদের সংগঠন-নোয়াবের সদস্য করা হয়নি। সম্পাদকদের সংগঠন-সম্পাদক পরিষদেও আমাকে রাখা হয়নি। জাতীয় প্রেসক্লাবে আমার সদস্যপদ দেয়া হয়নি। তবে জাতীয় প্রেসক্লাবের বর্তমান সভাপতি ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই যে, তারা বিলম্ব হলেও আমাকে এবার সদস্য পদ দিয়েছেন। এতদিন সদস্যপদ না দেয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,আমার দেশ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পক্ষে এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কণ্ঠস্বর-কাজেই কোন পত্রিকা মালিক ও সম্পাদক আমার দেশকে সহ্য করতে পারেননি। সুতরাং আমার দেশ ধ্বংস করায় শেখ হাসিনার সঙ্গে অধিকাংশ মালিক এবং সম্পাদক আনন্দিত হয়েছেন। তাই বর্তমান সরকার মিডিয়া সংস্কারের যে কথা বলছেন, তার আগে মিডিয়া মালিক ও সম্পাদকদের সংস্কার করতে হবে। যদিও সংস্কারে এত এত কমিটি হচ্ছে-তারা কবে সংস্কার শেষ করবেন তা জানি না। একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান মিডিয়া মালিক-সম্পাদকদের চরিত্র সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, সংগ্রামের প্রবীণ সম্পাদক আবুল আসাদকে আওয়ামী ছাত্রলীগের গুন্ডারা দাড়ি ধরে টেনে নিয়ে যায়, নির্যাতন করে। কোথায় ছিলেন বাংলাদেশের সম্পাদকরা। নোয়াব কোথায় ছিল। কারও মুখেতো প্রতিবাদ শুনিনাই। অথচ তার মত বিজ্ঞ সম্পাদক কয়জন আছেন? তিনি বুদ্ধিজীবী না? নাকি তিনি ইসলামের কথা বলেন, তার দাড়ি আছে এজন্য তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা কথা বলেননি। আরেকজন ইত্তেফাকের সম্পাদক মইনুল হোসেনের দাড়ি ছিল না। তাকেও আদালত চত্ত্বরে নাজেহাল করা হয়েছে। ছাত্রলীগের নামধারী নিকৃষ্ট কতগুলো মহিলা তাকে যেভাবে অপমান করেছেন, তার প্রতিবাদ কোন সম্পাদক করেননি। তাহলে এই মালিক-সম্পাদকদের বিরুদ্ধেও আমাদের আওয়াজ তোলা উচিত। কারণ এই মিডিয়া গত ১৬ বছরে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে কাজ করেছে। হাসিনার ফ্যাসিবাদ যে এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল, তার পেছনে যেমন পুলিশের ভুমিকা ছিল, আমরা ও ব্যবসায়ীদের ভূমিকা ছিল. সেনাবাহিনীর ভুমিকাছিল তার সঙ্গে মিডিয়ারও ভূমিকা ছিল। সংবাদ সম্মেলনের নামে যে নির্লজ্জ তেলবাজি আমরা দেখেছি, তাতে সাংবাদিকদের লজ্জা পাওয়া উচিত।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মাহমুদুর রহমান বলেন, আমার দন্ড মওকুফের ব্যাপারে আমি এ সরকারকে দায়ী করি না। কারণ এজন্য আবেদন করতে হয়, আমি তা করিনি। আমি মনে করি আমাকে যে মামলা দেয়া হয়েছে, এর চেয়ে মিথ্যা মামলা আর হতে পারে না যে, আমি জেলখানায় বসে প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমানের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পতিত ফ্যাসিবাদি শেখ হাসিনার পুত্র জয়কে কিডনাপ করতে চেয়েছি। সেটা কিভাবে সম্ভব আমার জানা নেই, সেরকম একটি মামলায় আমাকে সাজা দেয়া হয়েছে। তবে সরকারের উচিত ছিল-এধরণের ভুয়া মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেয়া। এ রকম মামলা আরও থাকতে পারে। এধরণের মামলা উঠিয়ে নিলে হয়তো আমাকে জেলে যেতে হতো না।
আরেক প্রশ্নের জবাবে মাহমুদুর রহমান বলেন, আমার দেশ প্রেসের মেশিনারিজের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তৎকালীন ২০১৩ সালের হিসাবে ২৫ কোটি টাকার ওপরে। আর আমার কেনা কাগজের ক্ষতির পরিমাণ ১০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রেসের ক্ষতি ৩৫ কোটি টাকা। অন্যান্য ক্ষতি অনেক টাকার ব্যাপার, সেগুলো এখনো হিসাব করা হয়নি। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের মধ্যে যারা চাকরি পায়নি তাদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সরকারের দেখা উচিত। কিভাবে ক্ষতিপূরণ দেবে সেই হিসাব করা উচিত। আর চাকরিরতদের মধ্যে যারা শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন তাদের সবাইকে আমি আহবান জানাবো এক বছর আমার সঙ্গে লড়াই করতে।
তিনি বলেন, আমার ওপর হামলার ঘটনায় মামলা করেছি। আশা করি সরকার দ্রুত দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। আমার ওপর জুলুম করা হয়েছে, তার জন্য আমি আইনি প্রতিকিার চাইব। আর আমার দেশের ওপর যে জুলুম করা হয়েছে সেটা দেখার দায়িত্ব সরকারের। এ বিষয়ে সরকারের ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
আমার দেশ- এর বার্তা সম্পাদক জাহেদ চৌধুরীর পরিচালনায় সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে পত্রিকাটির নগর সম্পাদক এম আবব্দুল্লাহ, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ, ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম, আমার দেশ ইউনিট চিফ বাছির জামাল ও প্রেস ম্যানেজার গোলাম জিলানী উপস্থিত ছিলেন।