আবুল কাশেম জামালপুরঃ-
জামালপুরের টকবগে তরুণ যুবকরা দেশ মাতৃকার টানে ১৯৭১ এ দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অর্ন্তগত কোচ বিহার জেলার মহেন্দ্রগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধে একের পর এক যোগ দিতে থাকে । মুক্তিযোদ্ধের ১১নং সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল ভারতের মহেদ্রগঞ্জ। সেখানে ট্রেনিং নিয়ে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বীর সেনানীরা।
১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের তথ্যসূত্রে জানাগেছে, ৪ডিসেম্বর/৭১এর সর্বপ্রথম ধানুয়া কামালপুর,৫ডিসেম্বর বকসিগঞ্জ,৬ডিসেম্বর দেওয়ানগঞ্জ,৭ডিসেম্বর ইসলামপুর,৮ডিসেম্বর মেলান্দহ,১০ডিসেম্বর জামালপুর সদর এবং ১২ডিসেম্বর সরিষাবাড়ি শত্রু মুক্ত হলে জামালপুর সারা জেলায় বিজয় অর্জিত হয়। ৪ডিসেম্বর/৭১এর ধানুয়া কামালপুর ঐতিহাসিক বিজয় লাভের পর ঐদিন বিকালে বকসিগঞ্জ সদরে দ্বিতীয় দফা হানা দেয় মুক্তিযোদ্ধারা।
তাদের বীরত্ব পূর্ণ লড়াইয়ে ৫ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফা ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে বকসিগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়। একের পর এক বিজয় অর্জন করায় মুক্তিযুদ্ধাদের আত্মবিশ্বস ও মনোবল বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা রাতে মুক্তিযুদ্ধের নাসির কোম্পানীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দিনরাত প্রাণপণ লড়াই করে অবশেষে ৬ ডিসেম্বর ভোর রাতে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে তৃতীয় দফা শত্রু মুক্ত করেন। ৬ডিসেম্বর বিকালে মুক্তিযুদ্ধের জালাল কোম্পানি এবং বদি কোম্পানীর নের্তৃত্বে ইসলামপুর উপজেলায়য় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ঐ দিন বিকাল থেকে সারা রাত প্রাণপণে লড়াই করে অবশেষে ৭ডিসেম্বর ভোর রাতে পাক-হানাদারদের পতন ঘটিয়ে চতুর্থ দফা বিজয় লাভ করে ইসলামপুর। মিত্রবাহিনীর নির্দ্দেশে ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যা রাতে মুক্তিযুদ্ধের আলম কোম্পানী,বদি কোমম্পানীর নের্তৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মেলান্দহ উপজেলায় পাক-হানাদার বাহিনী বিরোদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। রাত ভর সম্মুখ যুদ্ধে পাকহানাদারদের পরাজিত করে অবশেষে ৮ডিসেম্বর ভোর রাতে মেলান্দহ পঞ্চম দফায় শত্রু মুক্ত করেন।
জামালপুর শহরের প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (পিটিআই) ছিল পাকসেনাদের চরম দূর্ভেদ্য শক্তিশালী ঘাঁটি। তাই মুক্তিযুদ্ধের মিত্র বাহিনীর ব্রিগ্রেড কমান্ডার হরদেব সিং ক্লেয়ার এর নির্দ্দেশে যুদ্ধকালিন আঞ্চলিক অধিনায়ক ইউসুফ আলীর নের্তৃত্বে ৮ডিসেম্বর নাসির কোম্পানী, বদি কোম্পানী, আলম কোম্পানিসহ মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা একত্রিত হয়ে জামালপুর শহরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেদিন মুক্তিযুদ্ধে মৃতঞ্জয়ী খেতাব প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সি (বীর প্রতীক) নিজের জীবন বাজি রেখে আত্মসমাপন পত্র নিয়ে পাকসেনা ক্যাম্প কমান্ডার কর্নেল সুলতান খানের কাছে চিঠি পৌছান। চিঠি পেয়ে পাকসেনা কর্মকর্তা আত্মসমাপণ অস্বীকার করে বীর প্রতীক জহুরুল হক মুন্সিকে চোখ বেঁধে অমানুষিক শারীরিক ও মানষিক নির্যাতন চালিয়ে রাতে তার শরীরে টাইম বোমা বেধে ব্রহ্মপুত্র নদে ফেলে দেয় পাক সেনারা। এ খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনী এবং মিত্র বাহিনীর সদস্যরা সিংহের মত গর্জে উঠে তুমুল আক্রমন শুরু করেন। পরদিন ভারতীয় বোমারু বিমান এসে পাকসেনা ক্যাম্পে মুহুমুহু বোমা বর্ষণ করতে থাকে। অবশেষে ১০ডিসেম্বর পাক-হানাদার বাহিনীর ২৩৫ জন সদস্য নিহত হলে ৩৭৬ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করলে জামালপুর সপ্তম দফা শত্রু মুক্ত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর ১১জন বীরযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন।
১১ডিসেম্বর মুক্তিবাহীনীর সদস্যরা সরিষাবাড়ি পাকহানাদার বাহিনীকে ঘিরে আক্রমন শুরু করে। ফলে ১২ডিসেম্বর পাকহানাদারদের সর্বশেষ পরাজিত করে জামালপুর মহকুমা বর্তমানে জামালপুর জেলা চুড়ান্ত ভাবে স্বাধীনতা বিজয় লাভ করে। এ সময় হাজারো মুক্তিগামী জনতা জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে। এ সময় স্বাধীন বাংলার বিজয়ী পতাকা উড়তে থাকে জামালপুরের সর্বত্র।