জুলাই শহীদদের ঋণ পরিশোধের একমাত্র উপায় অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা

সোমবার, জুন ২৩, ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানে যারা প্রাণ দিয়েছে, আহত হয়েছে-আমাদের কাছে তাদের ঋণ সীমাহীন। তাই জুলাই বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি পূরণে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। জুলাই বিপ্লবের প্রতি সম্মান জানানোর একমাত্র উপায় হলো— ২৪ এর জুলাই ও আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা।

তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দুইটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। সেগুলো পূর্ণ স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কাজ করছে।

রোববার (২২ জুন) হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দক্ষতা’ বিষয়ক জাতীয় সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, হাজারো তরুণ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ আজ এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত অতিক্রম করছে। জুলাই বিপ্লব ছিল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবিচারের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদের প্রতীক।

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। এতে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন— মধ্যে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টিফেন লিলার, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন।

জুলাই বিপ্লবে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি— এই দায়িত্ব আমি পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করব। তবে মনে রাখতে হবে, জুলাই বিপ্লব কেবল একটি স্বৈরাচারী সরকার পতনের ব্যাপার নয়। এটি ছিল সমাজজুড়ে বিদ্যমান গভীর অনিয়ম, পক্ষপাত ও ক্ষমতার বৈষম্যকে ধ্বংস করার এক প্রবল আকাঙ্ক্ষা।’

তিনি আরও বলেন, এই বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল এমন একটি সমাজ গড়া যেখানে স্বাধীনতা, সমতা ও মর্যাদা সব সিদ্ধান্ত এবং কর্মকাণ্ডের মূলনীতি হবে। আমরা আজ এই সংস্কারযাত্রার অংশ হিসেবে দায়বদ্ধ, যা আমরা জাতির প্রতি ঋণ হিসেবে বহন করছি। আমরা যে সংস্কারের কথা বলছি, তা কোনো তুচ্ছ পরিবর্তন নয়। বরং তা এমন মূলগত রূপান্তর, যা গত ৫৪ বছরেও করা হয়নি।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা চাই এমন পরিবর্তন, যা একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে যেন তা স্বৈরাচারে রূপ না নেয়। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি, কীভাবে গণতন্ত্রের নামে নির্বাচনী কৌশল প্রয়োগ করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয় এবং প্রশাসনিক কাঠামোকে ভেঙে ফেলা হয়। এসব স্বৈরতান্ত্রিক কৌশল রোধে প্রয়োজন নতুন শক্ত কাঠামো। এই সংস্কার প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বিচারব্যবস্থা। একে স্বাধীন ও কার্যকর না করতে পারলে, কোনো অগ্রগতি সম্ভব নয়।

স্বাধীনতা, দক্ষতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থা আজ পুনর্গঠনের পথে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এই সংস্কার উদ্যোগ চলছে, আইন মন্ত্রণালয় এতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারা দেশের বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সুগভীর গবেষণা করে প্রতিবেদন দিয়েছে। আনন্দের বিষয় হলো, কমিশনের সুপারিশ এবং প্রধান বিচারপতির প্রস্তাবনার মধ্যে অনেক জায়গায় মিল রয়েছে— যা একটি অভিন্ন লক্ষ্য ও প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন।

তিনি জানান, প্রস্তাবিত সংস্কারের মধ্যে রয়েছে— অবকাঠামো উন্নয়ন ও ডিজিটাল সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিচার প্রক্রিয়ার দক্ষতা বৃদ্ধি, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নতুন ব্যবস্থা, জেলা আদালতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে বিচারক বদলির জন্য আলাদা বিধি প্রণয়ন এবং বিচার বিভাগের নিজস্ব সচিবালয় গঠনের প্রস্তাব। এছাড়া, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরায় সক্রিয় করা হয়েছে, যাতে বিচারপতিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যদি এই সংস্কার পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে এটি বাংলাদেশের নতুন ভোর আনবে— সেই স্বপ্নের প্রতিফলন হবে, যার জন্য এত রক্ত ঝরেছে।

তিনি আরও বলেন, ‘আসুন, অতীতের বাধাগুলো ভুলে আমরা সামনে এগিয়ে যাই।বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করে আমরা সমতা, মর্যাদা ও স্বাধীনতার এক সমাজ গড়ে তুলি।’ একটি স্বাধীন ও কার্যকর বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকার দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশ সংস্কারের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, প্রতিটি জাতির জন্য আসে এমন এক রূপান্তরের মুহূর্ত, একটি নতুন সূচনার সুযোগ। এটাই আমাদের সেই মুহূর্ত। আমরা চাই অতীতের অরাজকতা, দুঃশাসন, স্বৈরতন্ত্র দূর করে সুশাসন ও আইনের শাসনের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে।

তিনি আরও বলেন, এমন সুযোগ বিরল। অনেক জাতির জন্য এ একবারই আসে। আমাদের ক্ষেত্রেও হয়তো এটাই সেই একবারের সুযোগ। যদি আমরা তা হাতছাড়া করি, তাহলে এটা আর ফিরে নাও আসতে পারে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজ এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে, আমাদের অঙ্গীকার হোক —আমরা এটা সফল করব, বাস্তবে রূপ দেব। কারণ এই সুযোগ আর ফিরে আসবে না’।

তিনি বলেন, আমরা জুলাই বিপ্লবের বার্ষিকী উদ্‌যাপন করতে যাচ্ছি। এখন প্রায় এক বছর হতে চলল, যখন আমাদের তরুণরা তাদের রক্ত দিয়ে স্বপ্ন লিখে দিয়েছিল। এখন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমাদের কাঁধে— নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রথম ধাপ হলো বিচারব্যবস্থা, স্বাধীনতা এবং দক্ষতা। যতক্ষণ না এই তিনটি শব্দ প্রতিষ্ঠা করা যায়, ততক্ষণ আর কিছুই কার্যকর হবে না। আর একবার এই সঠিক পথে শুরু করতে পারলে, বাকি সবকিছুই সম্ভব।

সূত্র : বাসস