ট্রাম্পের সামনে তিন নাটকীয় সিদ্ধান্ত

মঙ্গলবার, জুন ১৭, ২০২৫

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: চলমান ইরান-ইসরাইল উত্তেজনার পটভূমিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনো ইসরাইলের হামলায় সরাসরি সমর্থন জানাচ্ছেন, আবার কখনো কূটনৈতিক সমঝোতার কথা বলছেন। তার এই অদল-বদলের অবস্থান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে তার এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব তার অবস্থানকে অস্পষ্ট করে তুলেছে। সংঘাত যতই বাড়ছে, ততই অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।

এদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, এসব হামলা ‌‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পুরোপুরি সমন্বয় করেই’ চালানো হয়েছে।

তাহলে এখন প্রশ্ন হলো-ট্রাম্প কী কী বিষয় বিবেচনায় নিচ্ছেন? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এখন তার সামনে কী কী বিকল্প পথ খোলা রয়েছে?

১. নেতানিয়াহুর চাপে নতি স্বীকার ও সংঘাত বাড়ানো

গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েল যখন তেহরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের নেতাদের হুমকি দেন যে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ‘আরও ভয়ঙ্কর’ হামলা আসবে, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বোমায় সজ্জিত।

নেতানিয়াহুর মতো তিনিও বলেন, ইরান পারমাণবিক বোমার মালিক হতে পারবে না।

তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ট্রাম্প বলেছেন তার পছন্দের পথ (নেতানিয়াহুর মতো না) হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে একটি চুক্তি করা (এই পথটি তার নিজের দাবি করা ‘বিশ্বমানের চুক্তি-কারিগর’ ইমেজের সঙ্গেও যায়)।

কিন্তু কীভাবে সেখানে পৌঁছাতে হবে, সে বিষয়ে তিনি দ্বিধায় ভুগেছেন। কখনো শক্তির প্রয়োগের হুমকি দিয়েছেন, কখনো জোর দিয়েছেন কূটনীতির দিকে।

গত সপ্তাহে তার এক বক্তব্যেও এই দ্বিধা ফুটে ওঠে। তিনি বলেছিলেন, ইরানের ওপর ইসরায়েলি হামলা হয়তো চুক্তিতে সাহায্য করবে, অথবা সেটা পুরো চুক্তিকেই ‘বিধ্বস্ত’ করে দেবে।

তবে এই অনিশ্চয়তাপূর্ণ অবস্থান বা অস্থিরতাকে অনেক সময়ই ট্রাম্পের সমর্থকেরা তার কৌশল হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। এটাকে তারা বলছেন ‘ম্যাড ম্যান থিওরি’ বা কূটনীতির তথাকথিত ‘পাগল তত্ত্ব’।

এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ইচ্ছাকৃত অনিশ্চয়তা বা অপ্রত্যাশিত আচরণ প্রতিপক্ষকে (বা ট্রাম্পের ক্ষেত্রে, এমনকি মিত্রদেরও) বাধ্য করে একটি নির্দিষ্ট পথে আসতে। এই তত্ত্বটি মূলত প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের স্নায়ুযুদ্ধকালীন কৌশলের সঙ্গে সম্পর্কিত।

ট্রাম্পের কিছু উপদেষ্টা ও সমর্থক ইরান ইস্যুতে এই ‘পাগল তত্ত্ব’ কৌশলের পক্ষে। তাদের বিশ্বাস, এসব হুমকিই শেষ পর্যন্ত সফল হবে। কারণ তারা মনে করেন, ইরান আসলে আলোচনায় আগ্রহী না (যদিও ২০১৫ সালে ওবামার নেতৃত্বে হওয়া একটি পরমাণু চুক্তিতে ইরান স্বাক্ষর করেছিল, যেটা ট্রাম্প পরে বাতিল করে দেন)।

নেতানিয়াহু দীর্ঘদিন ধরে ট্রাম্পকে সামরিক পথ বেছে নিতে চাপ দিয়ে আসছেন, কূটনৈতিক পথ নয়। আর ট্রাম্প শেষমেশ হয়তো ইরানের নেতৃত্বের প্রতি তার আগ্রাসী হুমকিগুলোকেই বাস্তবায়নের দিকে এগোবেন। যদিও তিনি বহুবার নোবেল শান্তি পুরস্কার জেতার আগ্রহ দেখিয়েছেন।

ইসরায়েল গোপনে আরও জোরালোভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়াতে চাইতে পারে, যেন তারা মনে করে কাজটা যেন দ্রুত শেষ করা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন বাংকার ধ্বংসকারী বোমা আছে যা ইরানের ফরদো-তে অবস্থিত ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র ধ্বংস করতে পারে বলে ইসরায়েলের বিশ্বাস।

এদিকে, যতই সংঘর্ষ বাড়ছে, ততই কংগ্রেসের রক্ষণশীল রিপাবলিকানদের কাছ থেকে ট্রাম্পের ওপর চাপ বাড়ছে, যারা বহুদিন ধরেই ইরানে সরকার পরিবর্তনের ডাক দিয়ে আসছেন।

ট্রাম্প হয়তো এটাও ভাবছেন, এতে ইরান দুর্বল অবস্থায় আলোচনায় বসতে বাধ্য হবে।

কিন্তু সত্য হলো, ইরান ইতোমধ্যেই আলোচনার টেবিলে ছিল, কারণ তার দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে ওমানে রবিবার (১৫ জুন) ষষ্ঠ দফা আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন সেই আলোচনাও বাতিল হয়ে গেছে।

২. মধ্যপন্থা

এখন পর্যন্ত ট্রাম্প বারবার বলেছেন, ইসরায়েলের হামলায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িত নয়। তবে সংঘাত বাড়লে সেটি ট্রাম্পের জন্য বড় ঝুঁকি নিয়ে আসতে পারে, এমনকি তা তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে।

ইতোমধ্যেই আমেরিকার নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার ও স্থলভিত্তিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলা থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করতে সহায়তা করছে।

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কিছু উপদেষ্টা হয়তো তাকে সতর্ক করছেন যে এই মুহূর্তে এমন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য, যা ইসরায়েলের ইরানবিরোধী হামলাকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে। কারণ কিছু ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে প্রাণঘাতী হামলা করেছে।

নেতানিয়াহু এখন বলছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনির ওপর হামলা চালালে সেটা সংঘাত বাড়াবে না, বরং সংঘাতের শেষটা এখানেই।

কিন্তু নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা কিছু সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ট্রাম্প স্পষ্ট করে বলেছেন যে তিনি এমন হামলার বিপক্ষে।

৩. সমর্থকদের চাপ এবং পেছনে সরে আসা

ট্রাম্পের মনে যেসব বড় রাজনৈতিক বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে, তার একটি হলো তার দেশের অভ্যন্তরীণ সমর্থন।

কংগ্রেসের বেশিরভাগ রিপাবলিকান সদস্য এখনো ইসরায়েলকে জোরালোভাবে সমর্থন করেন, যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ চালিয়ে যাওয়া। এদের অনেকেই প্রকাশ্যে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের হামলাকে সমর্থন করেছেন।

কিন্তু ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ বা মাগা আন্দোলনের ভেতরে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর উঠে এসেছে, যারা এখন এই ‘লোহার মতো শক্ত’ ইসরায়েলকে সমর্থনকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করছে।

গত কয়েক দিনে তারা প্রশ্ন তুলেছেন, যেখানে ট্রাম্প ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মতো ঝুঁকি কেন নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র?

ট্রাম্পপন্থি সাংবাদিক টাকার কার্লসন শুক্রবার কড়া সমালোচনা করে লিখেছেন, প্রশাসনের দাবি যে তারা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত নয়। কিন্তু তা সত্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইসরায়েলকে নিজের মতো করে ছেড়ে দেওয়া।

তিনি বলেন, নেতানিয়াহু এবং তার ‘যুদ্ধপিপাসু সরকার’ এমনভাবে কাজ করছে, যাতে মার্কিন সেনারা বাধ্য হয়ে তাদের হয়ে যুদ্ধ করতে নামে।

কার্লসন লেখেন, ‘এই যুদ্ধে জড়ানো মানে হবে, যেসব কোটি কোটি ভোটার আশা করেছিলেন একটি সরকার আসবে যারা সত্যিই আমেরিকাকে অগ্রাধিকার দেবে, তাদের মুখের ওপর মাঝের আঙুল দেখানো।’

ঠিক একইভাবে, ট্রাম্পের কট্টর সমর্থক মার্কিন কংগ্রেস সদস্য মার্জোরি টেলর গ্রিন সোশ্যাল হ্যান্ডেল এক্সে পোস্ট করে লিখেছেন, ‘যারা যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরায়েল/ইরান যুদ্ধের পুরোপুরি অংশ বানাতে চায়, তারা ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা মাগা আদর্শের নয়।’

এটি ট্রাম্পের জন্য একটি বড় দুর্বলতার দিক প্রকাশ করে। এতে তার ওপর চাপ বাড়ে ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক নীতির থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার। আর কিছু কিছু প্রকাশ্য মন্তব্যে দেখাও যাচ্ছে, ট্রাম্প এই চাপের প্রতি সাড়া দিচ্ছেন।