মুখরোচক আর গুণেভরা গ্রীষ্মমন্ডলীয় টক ফল জলপাই। বাংলাদেশে একটি সুপরিচিত ফল। জলপাই গাছ বহুবর্ষজীবী গাছগুলোর মধ্যে একটি। জলপাই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ইলাইওকারপাস সেরাটাস। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে জলপাই ফল উৎপাদিত হয়।
জলপাইকে অনেকেই জয়তুন-এর সাথে এক করে ফেলে, যদিও এ দুটি সম্পূর্ণ আলাদা ফল। অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সুবিধার কারণে এটি একটি সম্পদ হিসাবে গণ্য করা হয়। জলপাই ফলের অনেক উপকারিতা রয়েছে, কারণ এটি একটি সম্পূর্ণ খাদ্য। আর এটি থেকে তেল বের করা হয়, যার স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও প্রসাধনী উপকারিতা রয়েছে। জলপাইয়ের একটি বিশেষ পবিত্রতা রয়েছে সমস্ত ইব্রাহিমীয় ধর্ম সম্বন্ধে। প্রতিদিন একটি করে জলপাই আপনার শরীরে ম্যাজিকের মত কাজ করবে।
কাঁচা জলপাই বেশ পুষ্টিকর, প্রচুর ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। জলপাই খোসাসহ খেতে হয়। খোসায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ। এই আঁশ নিয়মিত খাবার হজমে সাহায্য করে। আর পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত, বৃহদান্ত, কোলনের ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়।
কাঁচা ফল টাটকা, রান্না করে ও আচার তৈরী করে খাওয়া হয়। ভিটামিন সি’ জাতীয় ফল হলো জলপাই। মোটামুটি শীতকালীন সময়েই এই জলপাইয়ের দেখা পাওয়া যায়। তবে সারা বছর তো আর জলপাই পাওয়া যায় না। তাই জলপাইয়ের আচার তৈরি করে এটি অনেকদিন সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এই আচার যেকোন সময়ে ভাত, খিচুড়ির সঙ্গে খাওয়া যেতে পারে।
জলপাই আচারের জন্য দুর্দান্ত। জিভে জল আনা জলপাই আচার তৈরির জন্য কাঁচা ফলগুলো প্রথমে সেদ্ধ করা হয়। তারপর কড়াইতে তেল গরম করে তাতে বিভিন্ন মসলার মধ্যে ঢেলে দিয়ে পরে চিনি ও জল দিয়ে আবার কিছুক্ষণ রান্না করার পর ঠাণ্ডা করে পরিবেশন বা সংরক্ষণ করা হয়।
জলপাই গাছ মাঝারি আকারের, ১০ থেকে ১২ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। শীতকালে পাতা ঝরে পড়ে, ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে নতুন পাতা আসে। সেই সঙ্গে আসে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাদা ফুল।
জলপাই ফলের জন্য বিখ্যাত হলেও এর ফুলের সৌন্দর্য অসাধারণ। সারা গাছজুড়ে অসংখ্য ফুলের যে মেলা বসে, তার সৌন্দর্য উপেক্ষা করা কঠিন। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি মলিন সাদা রঙের থোকা থোকা ফুলগুলো ফোটে। ফল খাবার উপযোগী হয় শরৎ-হেমন্তে। তখন ফলের বাইরের আবরণ সবুজের কাছাকাছি একটি বিশেষ রঙ ধারণ করে। এ কারণে জলপাই রঙ সবার কাছে একটি বিশেষ রঙ হিসেবে পরিচিত। জলপাইয়ের গড়ন প্রায় আমড়ার মতোই। তবে আমড়ার চেয়ে আকারে ছোট। এর পাতলা আবরণের ভেতর থাকে খাবার উপযোগী শাঁস ও একটি শক্ত আঁটি বা বীজ।
জলপাই ফলের ওজন ১৫.৭৮ থেকে ২২.৪৬ গ্রাম, দৈর্ঘ ৪.০৭ থেকে ৪.৪৯ সে:মি:, ব্যাস ২.৬২ থেকে ২.৮৯ সে:মি: হয়ে থাকে। ফলের রং হয় গাঢ় সবুজ, একটি বাদামী বীজ থাকে ফলের মধ্যখানে, বীজের চারপাশ ঘিরে থাকে টক-মিষ্টি স্বাদের শাঁস।
প্রতি ১০০ গ্রাম জলপাইয়ে খাদ্যশক্তি ৭০ কিলোক্যালরি, ৯ দশমিক ৭ শর্করা, ৫৯ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১৩ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি। কাঁচা ফলের শাঁস কিছুটা টক, যা ইঙ্গিত দেয় যে এটি ভিটামিন সি এর একটি ভাল উৎস। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ফল খনিজ, ভিটামিন, ফাইবার এবং মূল্যবান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। জেনে নিন জলপাইয়ের স্বাস্থ্য উপকারিতা।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী একটি ফল হতে পারে জলপাই। এটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। জলপাই রক্তের চিনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, জলপাইয়ের তেল ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে। রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে এই ইনসুলিন। যে কারণে জলপাই বা জলপাইয়ের তেলকে ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য উপকারী বলে মনে করা হয়।
ক্যানসার প্রতিরোধ করে
মরণঘাতি ক্যানসার প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জলপাইয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জার্মান ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে এই ফল। জলপাইয়ে আছে স্কোয়ালিন এবং টারপেনয়েড নামক উপাদান। এই দুই উপকারী উপাদান ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। তার মানে এই নয় যে ক্যান্সার ধরা পড়লেও জলপাই খেয়ে তা কমিয়ে ফেলতে পারবেন। বরং নিয়মিত জলপাই খেলে তা ক্যান্সার হওয়া থেকে আপনাকে দূরে রাখতে পারে।
হার্ট ভালো রাখে
জলপাই ভিটামিন ই-এর ভাল উৎস। হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কাজ করে জলপাই। জলপাইয়ের অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হার্ট ব্লক হতে বাধা দেয়। জলপাইয়ে আছে মনোস্যাটুরেটেড ফ্যাট। জলপাইয়ের ভিটামিন ই কোষের অস্বাভাবিক গঠনে বাধা দেয়। ফলে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি কমে।
খাবার তৈরিতে জলপাইয়ের তেল ব্যবহার করলে তা কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, এমনটাই প্রকাশ হয়েছে এনসিবিআই ওয়েবসাইটে। সেইসঙ্গে হ্রাস করে উচ্চ রক্তচাপও। অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ও উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়। এমন সব সমস্যা এড়াতে রান্নায় জলপাই তেল ব্যবহার করা যেতে পারে।
ওজন কমায়
জলপাই নিয়ে হওয়া বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে যে এতে থাকা লিনোলিক অ্যাসিড শরীরের বাড়তি মেদ কমাতে সাহায্য করে। সেইসঙ্গে জলপাই বা জলপাই তেল হজমের সময় এই বিশেষ অ্যাসিড বেশ কিছুটা উৎপাদিত হয়। ফলে তা শরীরের বাড়তি মেদ ঝরিয়ে ওজন কমানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
জলপাই প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি আছে। সর্দি, জ্বর ইত্যাদি দূরে থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
চোখ ভালো রাখে
বিশেষজ্ঞদের মতে, রান্নায় জলপাই তেল ব্যবহার করলে তা এজ-ইনসুলেটেড ম্যাকুলার ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে, এটি হলো বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ার সমস্যা। তাই চোখের জ্যোতি বাড়াতে রান্নার কাজে নিয়মিত জলপাইয়ের তেল ব্যবহার করুন।
পিত্তথলির পাথর দূর করে
রক্ত চলাচল ঠিক রেখে হৃৎপিণ্ডকে সঠিকভাবে কাজ করতে অবদান রাখে জলপাই। পরিণামে কমে যায় লাইপোপ্রোটিন। এই ফলে অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল এজেন্ট আছে, যা দেহের ক্ষতিকর জীবাণুকে ধ্বংস করে। নিয়মিত জলপাই খেলে পিত্তথলির পিত্তরসের কাজ করতে সুবিধা হয়। পরিণামে পিত্তথলিতে পাথরের প্রবণতা কমে যায়।
ত্বক ও চুল ভালো রাখে
জলপাইয়ের ভিটামিন সি ও ভিটামিন এ ত্বক, চুল, দাঁতের উজ্জ্বলতা ও পুষ্টি জোগায়। সানবার্নের মতো কালো ছোপ, দাগ, ব্রণের সমস্যা কমাতেও বেশ কার্যকর। সংক্রামক ও ছোঁয়াচে রোগগুলোকে রাখে অনেক দূরে। এ ছাড়া জীবাণুর আক্রমণ, চোখ ওঠা, চোখের পাতায় লালচে ফোড়া এই সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করে। জলপাইয়ের তেলে আছে ফ্যাটি এসিড ও এ্যান্টি অক্সিডেন্ট। যা ত্বক ও চুলের যত্নে কাজ করে। জলপাইয়ের ভিটামিন ই ত্বক মসৃণ রাখে। চুলের গঠনকে আরও মজবুত করে।
অ্যালার্জি প্রতিরোধ করে
জলপাইয়ের তেল রান্না করে খাওয়া এবং ত্বক দুটোর জন্যই খুব উপযোগী। গবেষণায় দেখা গেছে, জলপাই অ্যালার্জি প্রতিরোধে সহায়তা করে। জলপাইয়ে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি যা ত্বকের ইনফেকশন ও অন্যান্য ক্ষত সারাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
জলপাই সংরক্ষণের পদ্ধতি
আস্ত জলপাই সংরক্ষণ করা সবচেয়ে সহজ। কোন ঝক্কি ছাড়াই আপনি এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারবেন। শুধু লাগবে জিপার ব্যাগ। যা সুপারশপ গুলোতে পেয়ে যাবেন। সংরক্ষণের জন্য বড় জলপাইয় বেঁছে বোঁটা ছাড়িয়ে ধুয়ে নিন। পানি মুছে জিপার ব্যাগে রেখে দিন। খেয়াল রাখবেন যেন বাতাস না ঢুকে। ডিপ ফ্রিজে রাখলে এক বছর থাকবে অনায়াসে।
আরেকটি পদ্ধতি হলো লবণ-পানিতে সংরক্ষণ। কাঁচের বয়াম লাগবে। স্বচ্ছ একটি কাঁচের বয়ামে লবন মেশান। মুখে দিয়ে দেখলে লবনের পরিমাণ পরিষ্কার হবে। ঠিকঠাক লবন হলে ভালো ভালো জলপাই বেঁছে নিয়ে বয়ামে ডুবিয়ে দিন। ঢাকনা খুব শক্তভাবে লাগাতে হবে। পানি বদলে নিন ঘোলাটে হলে। এই জলপাই রান্নাতেও ব্যবহার করতে পারবেন।
সেদ্ধ করেও একবছর সংরক্ষণ করা যায়। প্রথমে কড়াইয়ে পানি ও ১ চা চামচ লবণ একসঙ্গে মিশিয়ে পানি ফুটিয়ে নিন। পানি ফুটে এলে জলপাই সামান্য ভাপ দিয়ে নিতে হবে। হালকা সেদ্ধ হলে ঠান্ডা করে জারে রেখে সংরক্ষণ করতে হবে। আবার সেদ্ধ জলপাই ব্লেন্ড করেও রাখা যায়। পরে চাইলে আচার বানিয়ে নিতে পারবেন।