ডিএসএ থেকে সিএসএ: ভয়-উদ্বেগ কি কাটল

শনিবার, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৩

 

        ।।  এম আবদুল্লাহ  ।।

সংশ্লিষ্ট সব মহলের প্রতিবাদ ও পুনর্বিন্যাসের জোরালো দাবি উপেক্ষা করেই জাতীয় সংসদে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) পাস করে নেওয়া হলো।
বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সংসদ অধিবেশনে এ সংক্রান্ত বিলটি পাস করার আগে উপস্থিত বিরোধীদলীয় সদস্যরা আইনটির সমালোচিত ধারাগুলো বাদ দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন। একই দাবি দেশের সাংবাদিক সমাজ, নাগরিক সমাজ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন করে আসছে—আইনটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে নীতিগত অনুমোদনের পর থেকেই। এ নিয়ে রাস্তায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে, সভা-সেমিনারে আইনটির সম্ভাব্য প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে। উদ্বেগের দিকগুলো সামনে এনে সংবাদমাধ্যমে প্রবন্ধ-নিবন্ধও লিখেছেন অনেকে। কিন্তু সেসবের থোড়াই কেয়ার করেছে সরকার। যেটুকু আমলে নিয়েছে তা অংশীজনদের স্বস্তি দিতে পারেনি।

লক্ষ করলে দেখা যাবে, সাইবার নিরাপত্তা আইন পাসসংক্রান্ত সংবাদ শিরোনামগুলোতে উদ্বেগ ও অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালের প্রায় একই সময়ে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ পাস হয়। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত আইন হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ)’। অতীতে বিশেষ ক্ষমতা আইন, জননিরাপত্তা আইন, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মতো রাজনৈতিক নিপীড়নমূলক আইনগুলো জাতীয়ভাবে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিল। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সমালোচনা কুড়িয়েছে। সে আইনটি বুধবার রহিত করে বিল পাস হয়েছে সংসদে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের প্রেক্ষাপটে সরকারের সাধুবাদ পাওয়ার কথা। নাগরিক সমাজ, সুশীল সমাজ, সংবাদমাধ্যমসহ স্টেকহোল্ডারদের তরফ থেকে স্বস্তি ও সন্তোষ প্রকাশের প্রত্যাশা করতে পারত সরকার। কিন্তু তা হয়নি। কারণ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারাকে ব্যবহার করে ভিন্নমতের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে হয়রানি করা হয়েছে, তার প্রায় সব ধারাই সাইবার আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ডিএসএ থেকে সিএসএতে রূপান্তরের ক্ষেত্রে সাজা ও জামিনে যতটুকু শিথিল করা হয়েছে, তা অপব্যবহার রোধ কিংবা ভীতি প্রশমনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না।

nagad
অবশ্য এটাও ঠিক যে, দেশের নাগরিকদের স্বস্তি দেওয়ার কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিলোপ বা নতুন আইনে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়নি। নাগরিক উদ্বেগকে সরকার আমলে নিতে চায়নি বলেই পাঁচ বছর ধরে যথেচ্ছ ব্যবহার হয়েছে। প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহল বিশেষত জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন ও পশ্চিমা বিশ্বের চাপেই সরকার এ বহুল আলোচিত ডিএসএ বিলোপ করে সিএসএতে রূপান্তর করেছে। এটা অনেকটা নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক মহলকে তুষ্ট করার প্রয়াসমাত্র।

বর্তমান জাতীয় সংসদে শক্ত বিরোধী দল নেই—এটা সবার জানা। সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলা যে কয়জন ভিন্নমতের সদস্য আছেন, তারা আইনটির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে প্রকারান্তরে এটি যে সংসদে বিতর্কের সুযোগ দিয়েই পাস হয়েছে, তা দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছেন। অবশ্য ট্রেজারি বেঞ্চের বাইরে যারা বসেন, তারা সংখ্যার বিচারে এতটাই ক্ষুদ্র যে, আইনটি পাস ঠেকানো দূরের কথা, বড় করে ‘না’ সূচক আওয়াজ স্পিকারের চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছানোর সামর্থ্যও রাখেন না। তবুও তারা কথা বলেছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা মুক্ত সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে যে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা উল্লেখ করেছেন। সাংবাদিক সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল বিভিন্ন সংগঠন ও সম্পাদক পরিষদের প্রতিবাদ যে আমলে নেওয়া হয়নি, তা তুলে ধরেছেন। সাইবার নিরাপত্তা আইন দিয়েও খুব সহজেই কাউকে হয়রানি করা যাবে উল্লেখ করে তারা বলেন, এ আইন ভিন্নমত, সমালোচনা ও মুক্তচিন্তা দমনের সবচেয়ে কার্যকর একটি হাতিয়ার হবে।

এটা কে না জানে, গত পাঁচ বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি শুধু সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা ও মুক্তচিন্তা দমনে প্রয়োগ করা হয়েছে। সাত হাজারের অধিক মামলা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পেশা ও শ্রেণি বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয়েছে সাংবাদিক সমাজ। এই আইনের কারণে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়েছে। ভয়ের পরিবেশ বিরাজ করায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দিনে দিনে ম্রিয়মাণ হয়েছে।

রূপান্তরিত সাইবার আইন ৫ সেপ্টেম্বর সংসদে তোলা হয়েছিল। এরপর তা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির সভায় বিশেষ আমন্ত্রণে সাংবাদিকদের কয়েকটি সংগঠনের নেতাদের উপস্থিতি ছিল। সে সভায় আমন্ত্রিত হয়ে আমারও মতামত দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমরা আইনটি পুনর্বিন্যাস করে নিপীড়নমূলক ধারাগুলো বাদ দেওয়ার জোর তাগিদ দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, বিশ্বব্যাপী সাইবার নিরাপত্তার যেসব আইন আছে সেখানে বাকস্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা, স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করা কিংবা ভিন্নমতের মানুষকে যখন-তখন শায়েস্তা করার বিধান নেই। সাইবার নিরাপত্তা শুধুই প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর নিরাপত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথা।

সংসদীয় দলের সভায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যাপারে উদ্যোগী ও অগ্রণী ভূমিকায় থাকা তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও ছিলেন। সাইবার আইনটি তার মন্ত্রণালয়ের হলেও সভায় তিনি নিস্পৃহ ছিলেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ছিলেন অনেকটা কঠোর ও অনমনীয় অবস্থানে। প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক আমাদের দাবিগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে নোট নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইনমন্ত্রীর নিরাপস মনোভাবে কয়েকটি ধারায় শুধু শব্দগত পরিবর্তন আনা হয়। পাশাপাশি ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ এ বিল থেকে বাদ দিতে রাজি হন। আমাদের দাবি অনুযায়ী মিথ্যা মামলার জন্য শাস্তির বিধান রেখে একটি ধারা যুক্ত করতে সম্মত হন। কিন্তু আইনের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি, ডিভাইস জব্দ ও গ্রেপ্তারের যে ক্ষমতা পুলিশকে দেওয়া হয়েছে, তা সংশোধনে অস্বীকৃতি জানান আইনমন্ত্রী। পরে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ৪২ ধারার প্রয়োজন আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—ডিজিটাল আইনের এ ধারাটিই পুলিশকে ত্রাস সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছিল। বাসাবাড়ি কিংবা অফিসে প্রবেশ, তল্লাশি এমনকি সন্দেহবশত কোনো ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। এতে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই অনেককে আটক, রিমান্ড এমনকি জেলের ভাত খাওয়াতে পেরেছে পুলিশ।

আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে কিছু প্রকাশ করেন, যা বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ সৃষ্টি বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, তাহলে তা হবে অপরাধ। এর সাজা হবে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। এ ধারাটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেমন অপব্যবহার হয়েছে, তেমনি সংবাদমাধ্যমের অনলাইন নিয়ন্ত্রণেও অপপ্রয়োগ দেখা গেছে।

মানহানিবিষয়ক ধারা সাইবার আইন থেকে বাদ দিয়ে প্রচলিত আইনে যে বিধান আছে, তা ডিজিটাল মাধ্যমে মানহানির ক্ষেত্রেও কার্যকর করার দাবি করলেও তা উপেক্ষিত হয়। এ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানিকর তথ্য প্রচার করলে তা হবে অপরাধ। এর সাজা হবে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানা। এ ধারাটি বিশেষত সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে প্রয়োগের আশঙ্কাই বেশি। কারণ কোন সংবাদে কার মানহানি হবে, তা বিচার করে সাংবাদিকতা করা খুবই কঠিন।

আইনে বলা হয়েছে—মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণা চালানো বা তাতে মদত দেওয়া হবে অপরাধ। এর সাজা সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। এ ধারাটি ডিজিটাল আইনের অনুরূপ। এর অপব্যবহার হয়েছে নির্বিচারে।

আইনে বলা হয়েছে, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে প্রকাশ করলে বা করালে তার সাজা হবে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। এ ধারাটিও ডিজিটাল আইনে অপপ্রয়োগ দেখা গেছে।

ডিজিটাল মাধ্যম থেকে তথ্য-উপাত্ত অপসারণ ও ব্লক করার যে ক্ষমতা পুলিশ এবং বিটিআরসিকে দেওয়া হয়েছে, তাও বহাল রাখা হয়েছে প্রায় অনুরূপ।

সংসদে পাসকৃত সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৫৯ নম্বর ধারা নিয়ে আমরা জোরালো আপত্তি তুলেছিলাম। এ ধারায় সাইবার নিরাপত্তা আইন বলবৎ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিলোপের বিধানের পাশাপাশি বলা হয়েছে, ডিজিটাল আইনের সব মামলা, তদন্ত, বিচার, আপিল এমনভাবে চলমান থাকবে যেন ডিজিটাল আইন রহিত করা হয়নি। তার মানে হচ্ছে, মন্ত্রীর দেওয়া পরিসংখ্যানমতে, ডিজিটাল আইনে বর্তমানে চলমান ছয় হাজার মামলা ওই আইনেই চলবে। একটি আইন রহিত করার পর ওই আইনে এত বিপুলসংখ্যক মামলা চলমান থাকা কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্ন তোলা হলেও তা অগ্রাহ্য করে আইনটি পাস করা হয়েছে।

সাইবার নিরাপত্তা আইনটি যেদিন সংসদে পাস করা হয় সেদিনের সংবাদপত্রে একটি বড় খবর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের জরিপে বাংলাদেশের ৯১ শতাংশ মানুষ গণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে তাদের মত ব্যক্ত করেছেন। গণতান্ত্রিক কোনো সমাজে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার, ভিন্নমত প্রকাশের কারণে মামলা ছাড়াই ধরে নিয়ে যাওয়া, কিংবা মুক্তচিন্তা প্রকাশের কারণে জেল-জুলুমের খড়গ নেমে আসার কথা ভাবাও যায় না। সাইবার আইনটি সেরকম ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতোই হাতিয়ার হবে বলে আমরা আশঙ্কা করি।

লেখক পরিচিতি :

এম আবদুল্লাহ

সভাপতি, বিএফইউজে