
।। মুহাম্মদ বাকের হোসাইন ।।
ভাষা সৈনিক, শিক্ষাবিদ এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক অধ্যাপক আবদুল গফুর সম্পর্কে স্মৃতি চারণের আগে জাতীয় পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাব কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এই পত্রিকায় চাকরি না পেলে অধ্যাপক আবদুল গফুর এবং এযাবৎকালের সেরা সাংবাদিক নেতা আনোয়ার জাহিদের সংস্পর্শ পেতাম না। ফলে তাঁদের সম্পর্কে জানাটা প্রত্যক্ষ ও প্রাণবন্ত হতো না। তাই জীবনে ভুরি ভুরি দুর্ভাগ্য থাকলেও বিভিন্ন সংবাদ প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে নানা মহৎপ্রাণ মানুষের সোহবত পাওয়াকে সৌভাগ্য হিসেবে ধরে নিয়ে সান্ত্বনার ঢেকুর তুলতে অসুবিধা কি!
জীবন ও সমাজে স্ববিরোধিতা, মিথ্যা, অন্যায়, দায়িত্বহীনতা ও ভণ্ডামির জোয়ার দেখে হতাশাগ্রস্ত মানুষ অভিধান থেকে সততা,নিষ্ঠা,চারিত্রিক মাধুর্য ও সংহতি এবং দায়িত্বশীলতাসহ ইত্যাকার মানবীয় গুণাবলির দ্যোতক শব্দগুলো মুছে ফেলার জন্য বারবার উদ্যত হলেও যেসব লোকের দিকে তাকিয়ে শব্দগুলো থেকে যায় অধ্যাপক আবদুল গফুর তাঁদেরই একজন। আজ ২৭ সেপ্টেম্বর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে অধ্যাপক আবদুল গফুরের স্মৃতির প্রতি অতল শ্রদ্ধা।২০২৪ সালের এই দিনে নিষ্ঠুর মৃত্যু আমাদের কাছ থেকে তাঁকে চিরদিনের জন্য ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শাহী দরবারে কাতর ফরিয়াদ অধ্যাপক আবদুল গফুর জাতি ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে যে খেদমত করে গেছেন তিনি যেনো তা কবুল করে সেই অছিলায় মরহুমকে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান করেন,আমিন।
অধ্যাপক আবদুল গফুরের ইনকিলাবে যোগদান নিয়ে রয়েছে চমকপ্রদ ঘটনা। ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক মন্ত্রী আলহাজ মাওলানা আবদুল মান্নানের বুদ্ধিমত্তা এবং কর্ম বীরত্ব সুবিদিত বিষয়। মাওলানা মান্নান ইনকিলাব প্রতিষ্ঠা উদ্যোগের শুরুতে এই পত্রিকায় যোগদানের জন্য অধ্যাপক আবদুল গফুরকে প্রস্তাব দিলে তিনি নানা কারণে দ্বিধায় পড়ে যান। মাওলানা মান্নান একদিন অধ্যাপক গফুরকে বলেন, আমাকে আপনি পছন্দ নাও করতে পারেন কিন্তু আমার কোনো ভালো প্রয়াসকে অপছন্দ করার তো কারণ নেই। সেক্ষেত্রে আপনার কি উচিত না আমার মহৎ প্রয়াসে সহযোগিতা করা। মাওলানার এই কথায় অধ্যাপক গফুর শরমিন্দা হয়ে ইনকিলাবে যোগ দেন। শুধু অধ্যাপক গফুর কেনো, এভাবেই মাওলানা মান্নান তাঁর প্রতিষ্ঠানে বিশিষ্ট নজরুল গবেষক মরহুম শেখ দরবারে আলম,মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ,সুলতান আহমদ, মিনহাজুর রহমানসহ বহু গুণী ও পণ্ডিত লোককে জড়ো করেছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে সাংবাদিকতায় ইনকিলাবের মূলনীতি যেমন ছিলো মাওলানা আকরম খাঁ প্রতিষ্ঠিত দৈনিক আজাদ-এর অনুরূপ মুসলিম চেতনা প্রভাবিত, তেমনি ইনকিলাবে নিয়োজিত জনশক্তির সিংহভাগও ছিলো আজাদ থেকে নেয়া। শুধু তাই নয় নীতিভ্রষ্টতার শিকার হয়ে আজাদ যেমন হারিয়ে গেছে একই কারণে ইনকিলাবও হয়ে পড়ে অকালবৃদ্ধ ও অপ্রাসঙ্গিক।
ইনকিলাবে ২০০৩ সালে চাকরি নেয়ার পর অধ্যাপক গফুরের সান্নিধ্যে এসে তাঁর যে বিষয়টি আমাকে মুগ্ধ করেছে তা হচ্ছে বয়োজ্যেষ্ঠ এই ব্যক্তিত্বের সক্রিয়তা ও সমাজ চেতনা। তিনি ইনকিলাবে ঘটমান যেকোনো বিষয়ে কানখাড়া থাকতেন। কোনো কোনো সময় মনে হতো তিনি এতো ছোটো বিষয়ে মাথা না ঘামালে কি হয় কিন্তু এখন ভাবি তিনিই সঠিক ছিলেন কারণ দূর ও কাছে যা কিছু জীবনঘনিষ্ঠ তা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা কোনোভাবেই উচিত না। আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞানও বলছে বিশেষ করে পরিণত বয়সে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন না করে সবসময় সমাজ সংশ্লিষ্ট থাকা স্বাস্থ্যের জন্যও উপাদেয়। একবার ইনকিলাবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের ইউনিট নির্বাচন আসে। যেহেতু ইউনিয়নের সাথে জড়িত থাকি তাই সহকর্মীরা পরস্পর আলোচনা করতে লাগলো। আমাকেও অনেকে জিজ্ঞেস করলেন। এক ফাঁকে আমি অধ্যাপক গফুরের অফিস কামরায় গিয়ে বিষয়টি নিয়ে তাঁর সাথে পরামর্শ করি। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আগাগোড়া বিশ্লেষণ করে যে মূল্যবান পরামর্শ দিলেন তাতে অনেক উপকৃত হয়েছি। মনে হলো পরামর্শ চাওয়ায় তিনি খুশি হয়েছেন। রাশভারি স্বভাবের হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে আঁচ করতে না পারলেও পরে বুঝতে পেরেছি সেদিন থেকে তিনি আমাকে পছন্দ ও স্নেহ করতে শুরু করেছেন। আরেকবার ইনকিলাবে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজের কাউন্সিলর নির্বাচন হয়। তিনি সবার সাথে আমার বিষয়ে কথা বলে পরামর্শ দেন যেহেতু আমি ইউনিয়নে সক্রিয় তাই ইউনিটের প্রয়োজনে আমাকে যেন কাউন্সিলর করা হয়। নির্ধারিত তারিখে দিনব্যাপী গোপন ব্যালটে নির্বাচন শেষে রাতে ভোট গণনায় দেখা গেলো আমার নাম সব ব্যালটেই আছে অর্থাৎ সবাই আমাকে ভোট দিয়েছেন। আমরা যেহেতু নির্বাচন করি তাই ভোটের কাঙ্গাল। একনম্বর কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে খুশি হলাম। আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া আদায় করলাম। সবাই অভিনন্দন জানালেন। দুয়েকজন অবশ্য মনঃক্ষুণ্নও হলেন।অধ্যাপক গফুরের দোয়া নিতে গেলাম, কৃতজ্ঞতা জানালাম। তিনি খুশিতো হলেনই তাঁকে কিছুটা পরিতৃপ্তও মনে হলো।
অধ্যাপক আবদুল গফুরের দায়িত্বজ্ঞানের প্রমাণ পাই ডিইউজে নির্বাচন কমিটির প্রধান থাকা কালে। ২০০৬ থেকে ১২ পর্যন্ত আমি দুই মেয়াদে ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের সময় তিনি ছিলেন নির্বাচন কমিটির প্রধান। কমিটিতে সদস্য হিসেবে আরো যারা ছিলেন তাঁদের সবার নাম এক্ষণে মনে না পড়লেও তৎকালীন দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদ, একই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক জয়নুল আবেদীন আজাদের নাম মনে আছে। কি কড়া নির্বাচন কমিটি রে বাবা! সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হতো। ইউনিয়ন অফিসের সহকারী মোহাম্মদ আলী নয়নকে প্রয়োজনে কাজে লাগানোর জন্য রেখে সবাইকে বের করে দিয়ে রুদ্ধদ্বার কক্ষে নির্বাচন কমিটির কাজ চলতো। আমার প্রতি নির্দেশ ছিলো জাতীয় প্রেসক্লাব লাউঞ্জে অপেক্ষমাণ থাকার যাতে যেকোনো জরুরতে সাথে সাথে পাওয়া যায়। পান থেকে চুন খসলে খবর হয়ে যেতো। একবার খসড়া ভোটার তালিকা থেকে চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় ভোটার সংখ্যা একজন বেড়ে গেলে মহা ফ্যাসাদে পড়ে যাই। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে মনে করা যাচ্ছিলো না ঘটনাটা কি? এসময় অধ্যাপক আবদুল গফুরের কঠোরতা দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। শেষে দেখা গেলো একজনের নাম তালিকায় দুইবার উঠেছে। আজকাল নির্বাচন কমিটির কারো কারো কাণ্ড দেখে হতাশ হতে হয়। ফলে আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে নামে আর নানা গোল বাধে। অধ্যাপক আবদুল গফুর ইউনিয়নের বার্ষিক স্মরণিকা ছাড়াও মে দিবসসহ বিভিন্ন উপলক্ষে প্রকাশিত সাময়িকীতে অনুরোধ করা হলে লেখা দিতেন। কখনো তিনি না করতেন না। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা নিয়েও তিনি লেখা দিয়েছেন।মাঝে মাঝে শারীরিক কারণে অপারগতা প্রকাশ করলেও শেষপর্যন্ত দিতেন এবং সবার আগে। দায়িত্ব নিয়ে শিথিলতা দেখিয়েছেন এমন কোনো নজির তাঁর কাছে পাইনি। রোগশয্যা থেকেও খবর নিয়েছেন নির্বাচন কমিটির কাজ ঠিকটাক চলছে কি-না বা লেখাটা জায়গামতো পৌঁছেছে কি-না। তিনি হচ্ছেন অধ্যাপক আবদুল গফুর।
অধ্যাপক গফুরকে আমি ভাই সম্বোধন করতাম। আমার চেয়েও বয়স ও পেশায় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা তাঁকে স্যার বলতেন। তাদের কেউ কেউ আমার ভাই সম্বোধনকে আড় চোখে দেখলেও গুরুত্ব দিতাম না। এক্ষেত্রে আমার একটি পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। প্রথমত পেশার লোক তিনি যতো প্রবীণই হোক না কেনো অনেক আগে থেকেই ভাই সম্বোধনের রেওয়াজ প্রতিষ্ঠিত। অনেকের মতো আমিও এতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি বলে রেওয়াজ ভাঙ্গা সঠিক মনে করি না, দ্বিতীয়ত অতি ভারী সম্বোধন করে বয়োজ্যেষ্ঠকে মাথায় তুলে রাখার চেয়ে তাঁকে আপন মনে করে প্রাত্যহিক জীবনের সাথে সম্পৃক্ত রেখে চিরসবুজ ভাবার মধ্যে একধরনের সার্থকতা আছে। এপ্রসঙ্গে প্রবীণ সাংবাদিক মরহুম মাশির হোসেন হীরুর একটা উক্তি আমার খুব পছন্দ। তিনি একবার বলেছিলেন আমাকে বিশাল মুরব্বি বানিয়ে মাথার উপর তুলে না রেখে বুড়ো বয়সে একটু সঙ্গ দিও।এতে আমি বেশি খুশি। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতা মরহুম মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী দলের প্রথম দফা আমির নির্বাচিত হয়ে বলেছিলেন আমি সবার ভাই ছিলাম,ভাইই থাকতে চাই। তাছাড়া ভাই সম্বোধনকে খুবই সম্মানিত ও আবেগপূর্ণ বিষয় মনে করি।
অধ্যাপক আবদুল গফুর ভাষা সৈনিক ছিলেন একথা বড়োই আটপৌরে, মামুলি। এ বর্ণনায় হক আদায় হয় না। বলতে হবে ভাষা আন্দোলন সংগঠকদের তিনি একজন কিন্তু তারপরেও তিনি একুশে পদক পেয়েছিলেন অনেক পরে। তাতেও অনেক কাহিনি। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে একবার তাঁকে একুশে পদক দেয়ার জন্য মনোনীত করে কিন্তু কোন এক অজানা ও রহস্যময় কারসাজির কারণে পদক দেয়া হয়নি। বাজারে এনিয়ে নানান কথা রটে। তবে ঘটনায় সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পরের বছর নতুনভাবে তাঁকে একুশে পদক দেয়া হয়। এজন্য ইনকিলাব কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক গফুরকে সংবর্ধনা দেয়। অনুষ্ঠানে ইনকিলাবের তৎকালীন উপদেষ্টা আনোয়ার জাহিদ বক্তৃতায় বলেছিলেন একুশে পদক অধ্যাপক আবদুল গফুরের সম্মান বাড়িয়েছে কি-না জানি না তবে এতে একুশে পদকের মর্যাদা বেড়েছে এটা নিশ্চিত। শুধু কি তাই, অধ্যাপক গফুরের মতো লোককে জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদ দেয়া হয়েছে তাঁর জীবন সায়াহ্নে এসে। ভাগ্যিস তবু হয়েছিলো, আর কয়েকটা বছর দেরি হলে সদস্যপদ ছাড়াই দুনিয়া থেকে যেতে হতো। অধ্যাপক আবদুল গফুরকে স্মরণ করা সৌভাগ্য ও সম্মানের ব্যাপার কিন্তু আপসোস নেতৃত্বের মারদাঙ্গায় না থাকার কারণে তাঁর জন্য নাগরিক শোক সভা তো দূর কি বাত সাধারণ শোক সভাও কেউ করেনি,জাতীয় প্রেসক্লাবও না।
অথচ অধ্যাপক গফুরের মতো লোকেরা নিজেই প্রতিষ্ঠান। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।
অধ্যাপক আবদুল গফুরকে হারানোর এই দিনে এসব ঘটনাখণ্ড স্মৃতির আরশিতে ভাসছে। আমি মরহুমের স্বজনদের হৃদয় নিংড়ানো সহানুভূতি জানাচ্ছি। আর প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় গফুর ভাইয়ের রূহানী ঠিকানায় চিঠি লিখে বলতে চাই যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, মুসলিম উম্মাহ থাকবে ততোদিন আপনি থাকবেন আমাদের হৃদয় পটে। আপনি ঘুরে ঘুরে, ফিরে ফিরে হবেন প্রাসঙ্গিক।
লেখক পরিচিতি: মুহাম্মদ বাকের হোসাইন
সাবেক সাধারণ সম্পাদক
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজে