
নিজস্ব প্রতিবেদক: কে এম নুরুল হুদাসহ সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) জিজ্ঞাসাবাদ করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নির্বাচনে নয়ছয় ও পাতানোর অভিযোগ বিষয়ে তথ্য পেতে এই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক আক্তার হোসেন।
দুদকের হাতে আসা অভিযোগে বলা হয়েছে, নূরুল হুদা এবং তার সহযোগীরা ‘সমীক্ষা ছাড়াই’ প্রকল্প গ্রহণ করে, টেন্ডার ছাড়া এবং বাজার মূল্যের চেয়ে ১০ গুণ বেশি দামে দেড় লাখ ‘নিম্নমানের’ ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনায় রাষ্ট্রের প্রায় ৩ হাজার ১৭২ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া শেখ হাসিনার আমলে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির ঘটনায় নূরুল হুদার সম্পৃক্ততা ছিল কিনা, তা নিয়েও অনুসন্ধান চলছে।
এ অভিযোগে বলা হয়, তিনি ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে’ নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ওসি এবং স্থানীয় সংঘবদ্ধ চক্রের সহায়তায় আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নির্বাচনকে ‘প্রভাবিত’ করেছিলেন। তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, র্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান ও অন্যদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ রয়েছে দুদকের হাতে।
সাবেক সচিব নূরুল হুদা ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিইসি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দেশের দ্বাদশ সিইসি। তার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় পর্যায়ের সব ভোট হয়। এ ইসির মেয়াদ শেষ হয় ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি।
দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, সংসদ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে কিছু অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এসব বিষয়ে অনুসন্ধান দলের সদস্যরা প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে পত্র পাঠিয়েছেন। তারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডও সংগ্রহ করেছেন। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগ্রহের জন্য অনুসন্ধান দল কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহের পর এবং অভিযোগ সংশ্লিষ্ট যারা দেশে অবস্থান করছেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সেসব বিচার বিশ্লেষণ করে অনুসন্ধান দল কমিশনে একটি প্রতিবেদন দাখিল করবে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই কমিশন পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই পায় ২৫৭টি আসন। সেবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিএনপি ও সমমনা দলগুলো পায় মাত্র সাতটি আসন। অধিকাংশ ভোট আগের রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগের মধ্যে বিরোধীদের ভাষায় সে নির্বাচনের নাম হয় ‘নিশি রাতের নির্বাচন’। এ অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমকে প্রধান করে ৭ সদস্যের একটি দল গঠন করেছে দুদক।
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, ওই নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়ম, যেমন ‘দিনের ভোট আগের রাতে’ করা, ব্যালট জালিয়াতি, কিছু কিছু কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি কাউন্ট দেখানো, ব্যাপক আর্থিক লেনদেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রার্থীকে জেতানো ইত্যাদি নানা অভিযোগ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং দুদকেও কিছু অভিযোগ জমা হয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন নথিপত্র তলব করে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু নথিপত্র দুদক হাতেও পেয়েছে।
একাদশ সংসদ নির্বাচন হয়েছিল কে এম নুরুল হুদার কমিশনের অধীনে। সেই কমিশনের সদস্য মাহবুব তালুকদার বিদায় বেলায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের ব্যর্থতার গ্লানি ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সিটিং এমপিদের বিষয়ে তাদের নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা সম্ভব ছিল বলে মনে করি না। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, এতেই বোঝা যায় নির্বাচন কেমন হয়েছে। এভাবে না-অবাধ, না-সুষ্ঠু, না-নিরপেক্ষ, না-আইনানুগ, না-গ্রহণযোগ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। সে অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই পরের তিনটি নির্বাচন হয়। প্রশ্নবিদ্ধ ওই তিন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করে যায়। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে। গতবছর ডিসেম্বরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিল করে রায় দেয় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর পথ তৈরি হয়। অবাধ ও নিরপেক্ষতা ‘নিশ্চিত করতে না পারায়’ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিন জাতীয় নির্বাচনে ‘জনগণের আস্থা ধ্বংস করা হয়েছে’ বলে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয় ওই রায়ে।