
জাতির সংবাদ ডটকম।।
স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিটির প্রস্তাবিত উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার পদ বিলুপ্তির প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ডিপ্লোমা মেডিক্যাল এসোসিয়েশন। ৬ জুলাই ২০২৫, রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি মো. আবুল কালাম আজাদ ভূইয়া এবং মহাসচিব এস এম মনিরুল ইসলাম সাদাফ কমিশনের প্রস্তাব পুনঃসংস্কার এবং কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসারদের ন্যায্য ৪ দফা বাস্তবায়নের দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় অনুমোদিত, বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ নিয়ন্ত্রিত, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (BMDC) স্বীকৃত ৪ বছর ৬মাস মেয়াদি মেডিক্যাল ডিপ্লোমা ডিএমএফ ডিগ্রিধারী। স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার “চিকিৎসাসেবা” নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ এবং নেদারল্যান্ড সরকারের যৌথ উদ্যোগে ১৯৭৬ সালে মেডিকেল এএ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (MATS) চালু হয়। যেখানে বর্তমানে ৪ বছর ৬ মাস ব্যাপি ডিপ্লোমা চিকিৎসা শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। সারাদেশে বর্তমানে ১৭টি সরকারি ও ১৯২টি বেসরকারি MATS চালু রয়েছে। BMDC নিবন্ধিত ৩৫,০০০ (পঁয়ত্রিশ হাজার) ডিএমএফ ডিগ্রিধারী চিকিৎসক, নিবন্ধনপ্রত্যাশী প্রায় ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) ডিএমএফ ডিগ্রিধারী চিকিৎসক এবং অধ্যয়নরত প্রায় ২০,০০০ (বিশ হাজার) শিক্ষার্থী। প্রায় লক্ষাধিক ডিপ্লোমা চিকিৎসকের বর্তমান সরকারি পরিচয় উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার। নিবন্ধনের শর্তানুসারে তারা “মেডিসিন, মাইনর সার্জারি ও ধাত্রীবিদ্যা” পেশায় নিয়োজিত রয়েছে।
১৯৭৯ সাল থেকে দীর্ঘ ৪৬ বছর ধরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে ডিপ্লোমা চিকিৎসকরা। যেখানে এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার বা উন্নত চিকিৎসাসেবার সুযোগ নেই, সেই ৮৫ ভাগ প্রান্তিক মানুষের পাশে আমরা আছি।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসাররা ৪৬ বছর ধরে বৈষম্যের শিকার।
প্রধান ৪টি বৈষমা:
১। সকল ডিপ্লোমাধারীরা ১০ গ্রেড পেলেও একমাত্র চিকিৎসা ডিপ্লোমাধাররা ১০ম গ্রেড থেকে বঞ্চিত।
২। আমাদের পেশাগত পরিচয় ডিপ্লোমা ডাক্তার হিসেবে স্বীকৃতি, মহামান্য হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন না করা।
৩। দীর্ঘ ১২ বছরের বেশি সময় ধরে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার পদে নিয়োগ বন্ধ করে প্রান্তিক মানুষকে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করা। দুই অধিদপ্তরের ৩২০০ পদের ছাড়পত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেওয়ার পরেও, নিয়োগ দেয়া হয়নি।
৪। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ক্লিনিক্যাল বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার উদ্যোগ বাস্তবায়ন না করা। বার বার স্বাস্থ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও যেমন- ব্যাচেলর অফ ক্লিনিক্যাল মেডিসিন এন্ড ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট বাস্তবায়িত হয়নি।
আমরা আশা করেছিলাম, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অধিষ্ঠিত সরকার দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে কাজ করবে। বিশেষ করে চিকিৎসাবঞ্চিত দেশের প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিটি জনস্বার্থে পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রান্তিক মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত করার পরিবর্তে সংস্কার কমিশন গোষ্ঠীস্বার্থ বাস্তবায়নের ফাঁদে পা দিয়েছে।
আমাদের আপত্তিসমূহ:
১। প্রতিনিধিত্বহীনতা ও পক্ষপাত: কমিশনের ১২ সদস্যের মধ্যে কেউই উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার বা ডিএমএফ ডিগ্রীধারী প্রতিনিধি নন। ১০ জনই এমবিবিএস চিকিৎসক এবং একজন ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।
২। পদবি পরিবর্তন ও মর্যাদাহানি: ‘উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার বা ডিএমএফ” পদ বাতিল করে “মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট” নাম প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এটি আদালত অবমাননার সামিল। কেননা, ১৯৯৬ সালে সরকার গেজেট জারি করে “মেডিকেল এ্যাসিস্ট্যান্ট” পদকে “উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার’ করে। গেজেট প্রকাশের পর দীর্ঘ আইনী লড়ই শেষে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশে ২০১২ সালে স্বাস্থ্য বিভাগ ‘উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার’ পদটি বাস্তবায়ন করে। সরকারের গেজেট এবং আদালতের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সংস্কার কমিশনের এই প্রস্তাবের পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কেননা এই সিদ্ধান্ত আদালতে গেলে পুরো সংস্কার প্রক্রিয়াই ঝুলে যেতে পারে।
৩। সেবার তথ্য বিকৃতি: আমাদের সেবার হার ও অবদান ইচ্ছাকৃতভাবে কম দেখিয়ে বিভ্রান্তিকর চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের দীর্ঘ ৪৬ বছর ধরে ৮৫% প্রান্তিক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সেবা দিয়ে আসছেন। নিবন্ধিত ৩৫ হাজার, নিবন্ধনের অপেক্ষমান ৫০ হাজারের অধিক ডিপ্লোমা চিকিৎসকগণ সরকারি ও বেসরকারিভাবে এবং ব্যক্তিগত চেম্বারে প্রতিনিয়ত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সেখানে ১ লাখ মেডিকেল অফিসার ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন মূলত নগরকেন্দ্রিক। অথচ সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে মেডিকেল অফিসারদের সেবার হার ৭৮% শতাংশ আর ডিপ্লোমা চিকিৎসকদের সেবার হার ১.৭% উল্লেখ করা হয়েছে। যে কোনো নিরপেক্ষ জরিপ করলেই এই তথ্যের অসারতা প্রমাণিত হবে।
৪। চিকিৎসা অনুশীলনের বৈধতা লঙ্ঘন: BMDC Act-2010-এর ধারা ১৫(৪) অনুযায়ী, মেডিসিন, মাইনর সার্জারি ও মিডওয়াইফারিতে ডিএমএফ চিকিৎসকের চিকিৎসা অনুশীলন ও প্রেসক্রিপশন দেয়ার অধিকার রয়েছে। BMDC আমাদের “D” ক্যাটাগরিতে রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স প্রদান করে থাকে। BMDC-এর আইন দ্বারা স্বীকৃত। অথচ কমিশনের রিপোর্টে এই বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছে, যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও দুরভিসন্ধিমূলক।
৫। স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টিকে “Allied Health Council” এর আওতায় আনার চক্রান্ত: ২০০৯ সালের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে পরিষ্কার বলা হয়েছে, DMF ডিগ্রিধারীদের Allied Health-এর আওতায় আনা যাবে না। বরং “Medical Educational Board of Bangladesh” গঠনের সুপারিশ ছিল। বিশ্বব্যাপী চিকিৎসাসেবা চিত্র এবং বাংলাদেশের বাস্তবতার নিরিখে এটাই সবচেয়ে যৌক্তিক পদক্ষেপ হতে পারে। কতিপয় ব্যক্তির ব্যক্তিগত অহমিকাকে প্রাধান্য না দিয়ে আমাদের অবশ্যই দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করা উচিত।
৬। প্রেসক্রিপশন ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ: কমিশনের খসড়ায় বলা হয়েছে, এমবিবিএস ব্যতীত কেউ প্রেসক্রিপশন বা আন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে পারবে না। এটি BMDC Act-2010 (Section 15(4)) এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা পরিপন্থী। প্রত্যন্ত গ্রাম তো দূরের কথা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও এমবিবিএস ডাক্তার নিয়মিত পাওয়া যায় না। এ তথ্য গণমাধ্যমে হাজার হাজার বার এসেছে। প্রেসক্রিপশনের জন্য এমবিবিএস পাস ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করলে দেশের বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে চিকিৎসা সেবাপ্রাপ্তি ও ওষুষপথ্য সেবন অসম্ভব হয়ে পড়বে। BMDC Act-2010 এর ধারা ১৫(৪) অনুযায়ী মেডিসিন, মাইনর সার্জারি ও মিডওয়াইফরী চিকিৎসা পেশায় ডিএমএফ ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন এবং এন্টিবায়োটিক প্রয়োগের অনুমতি রয়েছে। কিন্তু কমিশনের সুপারিশ স্পষ্টভাবেই আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করছে।
আমাদের দাবি:
১. কমিশনের খসড়া প্রতিবেদনে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার/ ডিএমএফ-দের সংযোজন ও পুর্নসংস্কার করতে হবে।
২. উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার/ ডিএমএফ চিকিৎসকদের প্রতিনিধিত্ব কমিশনে নিশ্চিত করতে হবে।
৩. BMDC রেজিস্টার্ড পেশার আইনি স্বীকৃতি ও অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে।
৪. পদোন্নতি, মর্যাদা ও পৃথক বোর্ড গঠনের আইনানুগ সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
আমরা বৈষম্য নয়, ন্যায্য অধিকার চাই। আমরা পেশাগত মর্যাদা, সাংবিধানিক নিরাপত্তা ও আইনি স্বীকৃতি রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশের প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে আমাদের ন্যায্য দাবি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।