প্রধানমন্ত্রীর চমকের অপেক্ষায় জামালপুরবাসী বিভিন্ন মেয়াদে ১১ মন্ত্রী, হয়নি কাংক্ষিত উন্নয়ন

বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ২৫, ২০২৪

 

 

জামালপুর প্রতিনিধিঃ-

জামালপুরকে বলা হয় তাজকেরাতুল আউলিয়া হযরত শাহ্ জামাল (রঃ)-এর পূণ্যভূমি। যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাই, জিঞ্জিরাম ও সূবর্ণখালি বিধৌত ২৬ লাখ জনপদের প্রধান দুঃখ নদীভাঙন। অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষিনির্ভর এ জেলার ৭টি উপজেলায় ৫টি নির্বাচনী আসন। এ পর্যন্ত দ্বাদশ সংসদীয় সরকারের কোনোটিতেই মন্ত্রিত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়নি জেলাবাসী। কখনো পূর্ণমন্ত্রী, কখনো প্রতিমন্ত্রী, কখনো উপমন্ত্রী। এমনকি একইসাথে একাধিক মন্ত্রীও জুটেছে জামালপুরে। প্রধানমন্ত্রীর পরেই দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ও প্রভাবশালী মন্ত্রীও ছিল এই জেলায়।

তবে দেশের চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় তুলনামূলক পরিবর্তন হয়নি এ জেলায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যতটা উন্নয়ন হয়েছে, তাতেও রয়েছে বড় ধরনের আঞ্চলিক বৈষম্য। নতুন কিছু প্রতিষ্ঠান চালুর প্রক্রিয়াধীন থাকলেও বন্ধ এবং ঝিমিয়ে পড়েছে অধিকাংশ পুরোনো শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

গত ৫২ বছরে জামালপুরে যারা মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন তাদের মধ্যে-

রাশেদ মোশাররফ: ১৯৭০ এর নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ছিলেন। ইসলামপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত সাবেক ময়মনসিংহ-২ বর্তমান জামালপুর-২ আসনে ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি এমপি হন। এরপর ১৯৭৯, ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে এমপি এবং ১৯৯৬ সালের এমপিসহ শেখ হাসিনা সরকারের ভূমি প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। রাশেদ মোশাররফ  ১৯৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১০ নভেম্বর ২০১১ সালে ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদার: জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসন থেকে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি হন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সরকারে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভায় তিনি আইন ও বিচার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে তিনি ফের এমপি হন এবং বেগম খালেদা জিয়ার সরকারে এলজিআরডি মন্ত্রী হন। এমনকি এসময়টায় তিনি দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রভাবশালী পদ মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। আব্দুস সালাম তালুকদার ১৯৩৬ সালের ৪ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯৯ সালের ২০ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন ।

আব্দুস সাত্তার: যিনি এম এ সাত্তার নামে পরিচিত। জামালপুর-১ (দেওয়ানগঞ্জ-বকশিগঞ্জ) আসন থেকে ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রথমবার এমপি হন। ১৯৮৮ সালে চতুর্থ সংসদে দ্বিতীয়বার এমপি হয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং রাষ্ট্রপতি এরশাদের মন্ত্রিসভায় তিনি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী, পরে বাণিজ্যমন্ত্রী, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী ও পরবর্তীতে একই মন্ত্রনালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী হন। এছাড়াও তিনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী এবং শিল্পমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

আবুল কালাম আজাদ: জামালপুর-১ (দেওয়ানগঞ্জ-বকশিগঞ্জ) আসন থেকে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে চারবার এমপি হন। তিনি জাতীয় সংসদের প্যানেল স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। নবম সংসদ চলাকালীন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

সিরাজুল হক: বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে জামালপুর-৫ (সদর) আসন থেকে এমপি হয়েছিলেন। বেগম জিয়ার প্রথম মন্ত্রিসভা ১৯৯১ সালে স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

মির্জা আজম: আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জামালপুর-৩ (মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ) আসন থেকে এ পর্যন্ত টানা সাতবার এমপি হয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালের আওয়ামী লীগ সরকারে তিনি বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এর আগে হন জাতীয় সংসদের হুইপ। তঁার নেতৃত্বে জেলায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়নের রুপকার হিসেবে পরিচিত হন এ জেলায়।

মাও. নুরুল ইসলাম: ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আব্দুস সালাম তালুকদারকে পরাজিত করে এমপি হন। পুরস্কার হিসেবে শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভায় তিনি ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। নুরুল ইসলাম ১৯৩১ সালে জন্ম এবং ৮৭ বছর বয়সে ২০১৮ সালে তিনি মারা যান।

রেজাউল করিম হীরা: জামালপুর-৫ (সদর) আসনে ১৯৯১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রথম নির্বাচন করে পরাজিত হন। পরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় তিনি ভুমিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।

মেজর জেনারেল (অবঃ) আনোয়ারুল কবির তালুকদার: বিএনপির সাবেক মহাসচিব ব্যারিস্টার আবদুস সালাম তালুকদারের ভাতিজা তিনি। ২০০১ সালে বিএনপির মনোনয়নে জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনে এমপি হন এবং চারদলীয় জোট সরকারের প্রথমদিকে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এবং পরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি বিএনপি ছেড়ে কর্নেল (অবঃ) অলি আহমদের সাথে এলডিপি গঠন করেন। আনোয়ারুল কবির তালুকদার ১০মে ২০২০ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

ডা. মুরাদ হাসান: নবম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনে দুইবার এমপি হন। ২০১৮ সালের আওয়ামী লীগের মন্ত্রীসভায় তিনি প্রথমদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী এবং মাঝামাঝিতে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে নানা কেলেঙ্কারির দায়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।

ফরিদুল হক খান দুলাল: জামালপুর-২ (ইসলামপুর) আসন থেকে নবম, দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ নির্বাচনে টানা চারবার এমপি হন। শেখ হাসিনার পঞ্চম মন্ত্রিসভায় তিনি ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হন। তঁার এলাকায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান না থাকলেও সর্বশেষ এবারের দ্বাদশ সংসদের মন্ত্রিসভায় তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয়ে পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।

প্রতিবারই মন্ত্রিত্বের স্বাদ পাওয়া জামালপুরবাসী একাধিক মন্ত্রীও পেয়েছিল একইসাথে। এবারও তেমন সম্ভাবনাই দেখেছিলেন সচেতনমহল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মূখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদকে সদর আসনের এমপি প্রার্থী হিসেবে দলীয় মনোনয়ন এবং বিজয় নিশ্চিত করাই ওই সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করে। বলা হয়ে থাকে, মির্জা আজমের নেতৃত্বে জামালপুরে অভূতপূর্ব উন্নয়নের নেপথ্যের কারিগর ছিলেন নবনির্বাচিত এমপি আবুল কালাম আজাদ।

অভিযোগ রয়েছে, উন্নয়ন যতটা হয়েছে ততটাই হয়েছে উন্নয়নের বৈষম্যও। আবুল কালাম আজাদ নির্বাচিত হওয়ার পর এ বৈষম্য দূরীকরণ এবং তঁার বড় কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল জেলার মানুষ। অবশ্য তা পূরণ না হলেও, হয়তো প্রধানমন্ত্রী বড় কোনো চমক রেখেছেন কিনা তা দেখার অপেক্ষায় জামালপুরবাসী।