আবুল কাশেম জামালপুর:-
লাল ফিতায় বাঁধা পড়েছে জামালপুর জেলা পরিষদের ৭৮২টি উন্নয়ন প্রকল্পের ফাইল। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও জেলা পরিষদের শীর্ষ দুই কর্মকর্তার মতানৈক্যের কারণে জামালপুরের সাত শতাধিক শিক্ষা, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্ধারিত সময়সীমা না থাকলেও এসব প্রকল্পের অর্থবছর ইতোমধ্যেই অতিক্রম করেছে। দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ।
জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দরপত্রের মাধ্যমে ১৪০টি ও পিআইসির মাধ্যমে ৪৩১টি প্রকল্প গ্রহণ করে জামালপুর জেলা পরিষদ। যার মধ্যে রয়েছে জেলা সদরসহ সাত উপজেলার স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, শ্মশানঘাট, ঈদগা মাঠ, এতিমখানা ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ থেকে ৫ লাখ টাকা। বরাদ্দের পরিমাণ ১৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, জেলা পরিষদের শীর্ষ দুই কর্মকর্তার মতানৈক্যের কারণে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না কোনো প্রকল্পের কাজ।
এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শতাধিক প্রকল্প এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১টি প্রকল্প এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। সব মিলিয়ে তিন অর্থবছরে ১৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ৭৮২টি প্রকল্প লাল ফিতায় বাঁধা পড়ে আছে।
জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, রাজস্ব ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় এসব উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৫৭১টি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় গত ২৭ জানুয়ারি। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য যথাসময়ে অনুমোদনও আসে। পরে প্রকল্পের নীতিমালা অনুযায়ী জেলা পরিষদ থেকে প্রতিটি প্রকল্প কমিটিকে বরাদ্দের চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দরপত্র আহ্বান করাসহ অন্যান্য কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত না নিয়ে প্রায় সাত মাস পর জেলা পরিষদের মাসিক সভায় প্রকল্পগুলো ফের যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হয়। সময়মতো সিদ্ধান্তহীনতার কারণে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে নতুন অর্থবছর। ফলে পুরোনো প্রকল্পগুলো আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সূত্রটি বলছে, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে শুরু থেকেই জেলা পরিষদের প্রশাসক ও জেলা প্রশাসক হাছিনা বেগমের সঙ্গে প্রধান নির্বাহী অনুমোদিত প্রকল্প ফের অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর অভিযোগ প্রকল্পগুলোর অর্থবছর এরই মধ্যে অতিক্রম করেছে কর্মকর্তা সরকার আব্দুল্লাহ আল মামুন বাবুর মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। ফলে সময়মতো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রকল্পগুলোর সুপারিশকারী হিসেবে জেলা পরিষদের প্রশাসক অর্থাৎ জেলা প্রশাসকের নাম দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হন তিনি। পরে তাঁর নাম বাদ দিয়ে পুনরায় রেভ্যুলেশন করা হয়। এ ছাড়া অনুমোদিত সব প্রকল্প পুনরায় যাচাই-বাছাই করার নির্দেশনা দেন জেলা প্রশাসক। মূলত এসব বিষয় নিয়েই জেলা প্রশাসকের সঙ্গে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। তথ্য বলছে, জেলা পরিষদে নেই প্রয়োজনীয় লোকবল। বিশেষ করে প্রকৌশল বিভাগে জনবলের অভাবে প্রকল্পের কোনো কাজ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রায় তিন বছর ধরে এখানে নেই উপসহকারী প্রকৌশলী। ফলে একজন সহকারী প্রকৌশলীর ওপর নির্ভর করছে পুরো জেলার সব উন্নয়ন প্রকল্প দেখভালের কার্যক্রম। এলজিইডি থেকে ধার করা একজন সার্ভেয়ার দিয়ে নামমাত্র চলছে মাঠ পর্যায়ের প্রকল্প পরিমাপের কাজ।
অভিযোগ রয়েছে, সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান ২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যোগদানের পর থেকেই সরকারি চাকরিবিধির তোয়াক্কা না করে সপ্তাহের তিন দিন ঢাকার বাসায়, চার দিন জামালপুর জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় অবস্থান করেন। অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর এষ্টিমেট যথাসময়ে তৈরি করেননি তিনি। ফলে প্রকল্পের অন্যান্য কার্যক্রমও করা যায়নি। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পর পর তিনটি কারণ দর্শানোর নোটিশ করেন জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। জামালপুর শহরের বোসপাড়া জামে মসজিদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আহাদ স্বাধীন জানান, মসজিদ উন্নয়নের জন্য ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। জেলা পরিষদের চিঠি পেয়ে প্রকল্প কমিটি জমা দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকেই চেকের জন্য ঘুরছেন জেলা পরিষদের বারান্দায়। এদিকে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম জামালপুর জেলা কার্যালয়ের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের জন্য ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সংস্থাটির সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পির ভাষ্য, সীমানাপ্রাচীর না থাকায় দুর্বৃত্তরা অফিসের তালা ভেঙে মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। অথচ দীর্ঘদিনেও বরাদ্দের টাকা পাচ্ছেন না তারা। শহরের দেওয়ানপাড়া জামে মসজিদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সাজ্জাদ হুসেন বলেন, মসজিদ উন্নয়ন বরাদ্দের ৩ লাখ টাকার জন্য পাঁচ মাস ধরে ঘুরছেন ডিসি অফিস ও জেলা পরিষদের অফিসে। সদর উপজেলার তিরুদ্ধা সত্যপীর উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান লেবুর ভাষ্য, স্কুলের মাঠ ভরাট ও সংস্কারের জন্য ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিল উত্তোলন করতে না পারায় কাজ করতে পারছেন না।
কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে এতগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিক জাহাঙ্গীর সেলিম। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সরকার আব্দুল্লাহ আল মামুন বাবুর সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য তিনি সময়মতো সব পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু মাসিক সভার সিদ্ধান্তে প্রকল্পগুলো পুনরায় যাচাই- বাছাই করা হয়। তা ছাড়া প্রকল্পের তালিকা একাধিকবার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এতে সময় ক্ষেপণ হয়। নিজেকে সম্পূর্ণ দায়মুক্ত দাবি করে তিনি বলেন, গত ২৬ অক্টোবর জেলা পরিষদের মাসিক সভায় প্রকল্পের তালিকা অনুমোদনের জন্য ফের মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। অনুমোদন পেলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। জামালপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক ও জেলা প্রশাসক হাছিনা বেগমের সঙ্গে কথা বলতে গত বুধবার তাঁর অফিসে গেলে তিনি সাক্ষাৎ না দিয়ে বেরিয়ে যান। পরে একাধিকবার ফোন করলেও রিসিভ করেননি। একপর্যায়ে এনডিসি শাহরিয়ার আহামেদ খান তাঁর ব্যবহৃত সরকারি মোবাইল ফোন দিয়ে কল ব্যাক করে জানতে চান ডিসির সঙ্গে কোন বিষয়ে কথা বলতে চান। পরে তিনি বলেন, জেলা পরিষদের প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার মোখতার আহমেদ বলেন, বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। দুজনই একে অন্যকে দোষারোপ করছেন। তিনি দুজনকেই স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করার। অন্যথায় দায়ী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।