
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
ঘুষ বানিজ্য ক্ষমতার অপব্যহারসহ একাধিক অভিযোগ থাকা সত্বে ও ফ্যাসিজমের দোসর রাজধানী উন্নয়ন কতৃপক্ষ (রাজউক) জোন-৫ এর পরিচালক হামিদুল ইসলাম এখনও বহাল তবিয়তে আছেন। দর্শনে এম.এ ডিগ্রীধারি হামিদুল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার খুব কাছের হওয়ায় পরপর দুটি পদোন্নতির মাধ্যমে রাজউক এর পরিচালক হয়েছে।
পরিচালক মো: হামিদুল ইসলামের ব্যক্তি ও চাকুরি জীবনের নানা বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানাগেছে, রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার রুপসায় তার গ্রামের বাড়ি । তিনি দর্শনে স্নাতকোত্তর সম্মান অর্জন করেছেন। ২০০৭ সালের ৫ ডিসেম্বর সহকারী সচিব হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। এরপর ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল উপ-পরিচালক (বোর্ড, জনসংযোগ ও প্রকৌশল) হিসেবে প্রথম পদোন্নতি পান। ২০২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পরিচালক (জোনাল) হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে এখন রাজউক জোন-৫ এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০৩৬ সালের ২৪ নভেম্বর অবসরে যাবেন তিনি।
তার এই দীর্ঘ কর্মজীবনে একাধিক দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে জড়িয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ১২ ফেব্রুয়ারি ও ২০ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে দুটি অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা পড়েছে। এই অভিযোগের সূত্র ধরে হামিদুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার রুপসায় সরেজমিনে গিয়ে কয়েকজনের সাথে কথা বলে দৈনিক সবুজ বাংলাদেশের অনুসন্ধানী দল।
গ্রামের বাড়ি রুপসায় হামিদুল ইসলামের কয়েকজন প্রবীণ প্রতিবেশির সাথে কথা বললে তারা জানান, চাকুরিতে যোগদানের তিন চার বছরের মধ্যে তার অর্থনৈতিক ব্যপক পরিবর্তন লক্ষ্য করেন তারা। এরপর ২০১৬-১৭ সালের দিকে তাদের কয়েকজনের ছেলেকে রাজউকে ড্রাইভারী চাকুরি দেয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছেন হামিদুল ইসলাম কিন্তু কয়েক বছরেও সম্পূর্ন টাকা তিনি ফেরৎ দেননি। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে মোঃ মাজেদুল ইসলামের দুদক-এ দায়ের করা অভিযোগেও রয়েছে এই তথ্য।
এই অভিযোগের সূত্র ধরে দৈনিক সবুজ বাংলাদেশের অনুসন্ধানী টিম কোন একজন ভুক্তভোগীকে খুঁজতে থাকে। অবশেষে কেরানীগঞ্জের শাহীন নামে এক ভুক্তভোগীকে খুঁজে পায় অনুসন্ধানী টিম। শাহিনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, পৈতৃক জমি বিক্রি করে চাকরির জন্য ৫লক্ষ টাকা দিয়েছেন পরিচালক হামিদকে। কিন্তু দুই বছর পর্যন্ত চাকরি হবে হচ্ছে করে আর হয়নি, টাকাও ফেরত পাননি। শাহীন রাজউকের ড্রাইভার হতে না পারলেও এখন ভাড়ায় লেগুনা চালিয়ে উপার্জন করছেন।
কথা হয় আব্দুল্লাহপুরের মতিনের সাথে, তিনি জানান ২০১৭ সালে রাজউকে ড্রাইভার নিয়োগ হচ্ছে জেনে তিনি চাকুরির জন্য চেষ্টা করেন। এক দালালের মাধ্যমে পরিচালক হামিদের কাছে আসেন তিনি । তার সাথেও চাকরির জন্য পাঁচ লাখ টাকার মৌখিক চুক্তি হয়। তিনি স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে এবং বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধার দেনা করে দালালের মাধ্যমে পরিচালক হামিদের হাতে টাকা পৌঁছান। দুই বছরেও চাকরি না হলে পরিচালক হামিদুল ইসলামের কাছে টাকা ফেরত চান তিনি, কিন্তু টাকার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন হামিদুল ইসলাম। ঘুষের টাকার কোন প্রমাণ না থাকায় হামিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই করতে পারেননি কেউ।
২০১০ সালের পর থেকে হামিদুল ইসলামের নিজ জেলা রংপুরে অধিক ফসলী জমি ও ঢাকায় একাধিক প্লট ও ফ্লাট কিনেছেন বলে জানাগেছে। এমনকি তার শ্বশুর বড়িতেও সম্পদ গড়েছেন বলে চাউর আছে। রংপুরের লালপুকুর মিঠাপুকুরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যাক্তি জানিয়েছেন, এই টাকা সে অবৈধ ভাবে আয় করেছেন তার কাছে হিসেব চাইলে সে কখনোই হিসাব দিতে পারবেন না।
২০ আগস্ট ২০২৫ তারিখে হামিদুল ইসলামের একাধিক দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয় উল্লেখ করে মোঃ দিদারুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন দুদক-এ। এই অভিযোগে বল হয়েছে মোঃ হামিদুল ইসলাম পরিচালক হওয়ায় এবং তার হাতে ইমারত পরিদর্শকদের এড়িয়া বন্টনের ক্ষমতা থাকায় ঘন ঘন এড়িয়া পরিবর্তন করে মাসিক চাঁদা তোলার কথা। নোটিশ বাণিজ্যের সাথে যুক্ত একাধিক ইমারত পরিদর্শক থেকে ১৫-২০ লাক্ষ টাকার বিনিময়ে ইমারত পরিদর্শকদের এড়িয়া বন্টন করেন এরপরেও প্রতিমাসে এড়িয়ার উপর নির্ভর করে ইমারত পরিদর্শকদের থেকে পরিচালক মোঃ হামিদুল ইসলাম ০৫-১০ লক্ষ টাকা নিয়ে থাকেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে অভিযোগে। ইমারত পরিদর্শকরা হামিদুল ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে যেমন টাকা আয় করত তেমন তাকেও দিত মোটা অংকের টাকা।
দুদক-এ দেয়া অভিযোগে উল্লেখ আছে হামিদুল ইসলামের নির্দেশে রাজউকের এক অথরাইজড অফিসার একাধিক নোটিশ গায়েব করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয় । রাজউকের অথরাইজড অফিসার ও ইমারত পরিদর্শকদের বিরুদ্বে অনেক অভিযোগ থাকলেও পরিচালক হামিদুল তাদের বিরুদ্বে কোন ব্যবস্থা নেয়না।
২০ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে কয়েকটি ভবনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন তিনি। এরমধ্যে রয়েছে নিউ এ্যালিফ্যান্ট রোডে হোল্ডিং-১১০,১১১,১১২ মালিক কামরুল হাসান। জানাগেছে ২০ লক্ষ টাকা লেনদেনের মাধ্যমে সেই ভবনকে পুনরায় কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন হামিদুল ইসলাম ও তার অথরাইড অফিসার। নিউ এ্যালিফ্যান্ট রোডে হোল্ডিং-৮২, মালিক মিসেস রহিমা সাহাবুদ্দিন এর ভবনটি আবাসিক অনুমোদন নিয়ে বানিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার করায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার পরে ১৫ লক্ষ টাকা লেনদেনের মাধ্যমে পরিচালক হামিদ ও তার অথরাইজড অফিসার এই বিষয়ে কাঠের চশমা পরেন। বর্তমানে ভবনটি আবাসিক হয়েও বানিজ্যিক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়াও মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন হাউজিং, বসিলা, চাদ উদ্যান, তেজতুড়ি বাজারসহ একাধিক ভবন মালিকের সাথে রফা করার মাধ্যমে মোটা অংকের অর্থ হাতাচ্ছেন এই জোন-৫ পরিচালক হামিদুল ইসলাম। তিনি তার এই অপকর্মকে চালিয়ে যেতে অভিজ্ঞ ইমারত পরিদর্শকদের এরিয়া যথাযথভাবে না দিয়ে নতুন ইমারত পরিদর্শক ও দুর্নীতিপরায়ন অথরাইজড অফিসারদের নিয়ে কাজ করেন। রাজউক আইন ও দেশের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন পরিচালক হামিদুল ইসলাম।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও রাজউক চেয়ারম্যান বরাবরে একাধিক অভিযোগ হওয়ার পরেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন হয়নি, বহাল তবিয়তেই আছেন জোন-৫ এর পরিচালকের দায়িত্বে।
পরিচালক হামিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে হওয়া দুদকের অভিযোগের বিষয়ে তার সাথে কথা বলার জন্য মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা বললেও এখনও কোন তদন্ত শুরু হয়নি পরিচালক হামিদুল ইসলামকে নিয়ে। এই বিষয়ে রাজউক এর চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলামের সাথে কথা বললে তিনি দৈনিক সবুজ বাংলাদেশর প্রতিনিধির সামনেই বিষয়টি পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-১) মোঃ মনিরুল হক কে গুরুত্বের সহিত দেখতে বলেন। রাজউক নিয়ে দৈনিক সবুজ বাংলাদেশ এর বেশকিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পর ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে এ. বি. এম. এহছানুল মামুন, পরিচালক (প্রশাসন) (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এর স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশ জারি করে রাজধানী উন্নয়ন কতৃপক্ষ।
অফিস আদেশে বলা হয়েছে এতদ্বারা সংশ্লিস্ট সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা/কর্মচারীগণের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রেক্ষিতে গাঠিত তদন্ত কমিটি/তদন্ত কর্মকর্তা প্রায়শই যথাসময়ে তদন্ত প্রতিবদন দাখিল করছেন না। যে সকল তদন্ত কমিটি/তদন্ত কর্মকর্তা অনুমোদিত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের শেষবারের মতো আগামী ১০(দশ) কার্যদিবসের মধ্যে তদন্তপূর্বক সুষ্পষ্ট তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। উল্লিখিত সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে ব্যর্থ কমিটি/তদন্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) চাকুরি বিধিমালা, ২০১৩ এর বিধি ৪১(৪) লঙ্ঘণের অভিযোগে অদক্ষতার জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।