বাসের এক তৃতীয়াংশ সিট তনয়াদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হোক

শুক্রবার, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪

 

 

         ।।সৈয়দা রাশিদা বারী ।।

সমাজে মানুষ ভালো থাকতে হলে, সবাইকে ভালো রাখতে হলে, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো অপরিহার্য। আর সেটা শুধু অর্থনৈতিক নয়- সামাজিক, মানসিক, মানবিক, রাজনৈতিক শাসনতাত্রিক সকল ক্ষেত্রে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সমস্যাগুলো সম্মিলিত ভাবে যেমন মোকাবেলা করা হয় ঠিক তেমন। নারীর যেকোন সমস্যাকেও তুচ্ছ ভাবা যাবে না। কেননা নারী সমাজে বংশ বিস্তার প্রজন্ম রক্ষার একমাত্র বাহক, মাধ্যম বা হাতিয়ার।

তাই মা দিবস, নারী দিবস, কন্যা দিবস, বাবা দিবস, ভালোবাসা দিবস ভালো পরিবেশ দিবস, ভালো ব্যবহার দিবস ইত্যাদি দিবসগুলো পালন হচ্ছে ভালো। তবে মুখের গাল গল্প করার মতো না করে, এক একটা ভালো কাজ দেখলে মেন্টালী ঐসব দিবস উপলক্ষ্যে এটা প্রতিষ্ঠা করা কিন্তু দেশ জাতি সমাজের মঙ্গল। মঙ্গল পৃথিবীর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নারী পুরুষের জন্য। তাই এইসব দিনে সাজ-গোঁজ, খেলা-ধূলা, লাফ-ঝাফ, খাওয়া-দাওয়ার সাথে, বিনোদনের পাশাপাশি, আসুন না কল্যাণমূখী কিছু করি।

হ্যাঁ ঠিক এটা মাথায় রেখেই বলছি: বাসের মধ্যে আড়া-আড়ি সিট সমাজের তনয়াদের জন্য ক্ষতির। সিট সংসারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তনয়াদের জন্য এক তৃতীয়াংশ ভাগ থাকা জরুরী। এখন তনয়ারা কেউ ঘরে বসে নেই। সরকারী, বেসরকারী, এন.জিও, স¦ায়ত্ত্বশাসিত সংস্থা যেমন: ব্যাংক, বীমা, তৃণমূল পর্যায় থেকে উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিগত অফিস, প্রিণ্ট এন্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহ, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীগুলো, গ্রুপ কোম্পানীগুলো প্রভৃতিতে মেয়েদের প্রাধান্য তুলনামূলকভাবে বাড়ছে।

কয়েক বছর আগেও রূপালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অফিসার, সিনিয়র অফিসার বা কর্মচারী পর্যায়ে পুরুষের চেয়ে মেয়েদেরই বেশি নিয়োগ দিয়েছে। কেজি নার্সারী থেকে সরকারী প্রাথমিক, মাধ্যমিক, স্কুল কলেজÑবিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষক অনেক বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছেলেদের হারে মেয়েরা কম নয়। রাস্তা ঘাট মেরামত, ইট সুরকি ভাঙা, বড় বড় বিল্ডিং এর কাজে আজকাল ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের অবস্থান কোন অংশে পিছিয়ে নেই।

এভাবে ফুল বিক্রেতা থেকে পথের ধারে পিঠা বানানো, কাঁচা তরকারির হাটে, পান-সিগারেটের দোকানে, মার্কেটগুলোতে, ভ্যানের উপরে দোকানী হওয়ার সংখ্যাও পুরুষেরই সমানে সমান। বই বিক্রি বা মালিক পর্যায়ে পাবলিশার্স, অনেক কিছুরই পরিচালনার ভূমিকায় মেয়েরা বেশ জোট বেঁধে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। বেচা-কেনার কাজ করছে। রাজনৈতিক আঙিনায় মেয়ে কর্মি কম নেই। গার্মেন্টেস্ এর শ্রমিক কর্মী মেয়েরা নি:সন্দেহে সিংহভাগ।

তাহলে কেন বাসে তনয়াদের জন্য মাত্র ৬/৯টি সিট বরাদ্দ হবে? তনয়াদের এক তৃতীয়াংশ সিট হলে দেশ এবং সমাজের জন্য মঙ্গল। শিক্ষা যেমন জাতির মেরুদন্ড, সংসারের মেরুদন্ডও ঘরের মা বউ কন্যা জায়া ভগ্নি। তারা অসুস্থ থাকলে সংসারে কোনদিনও উন্নতি হবেনা। চিরজীবন আপনি অশান্তির আগুনে জ্বলবেন। খরচও হবে নানা পর্যায়ে। সন্তানেরা অসুস্থ মাকে নিয়ে ভুগবেন। আয় রোজগারের অর্থ বেশির ভাগ চিকিৎসা পথে ব্যয় হবে। কাজেই সুস্থ জীবন যাপনের জন্য সতর্ক হলে ক্ষতি কি? এতে সুখে থাকবেন সংসারের সবাই মিলে মহাশান্তিতে।

এখন এর উপায়টা  শুনি? নিশ্চয় অজানা নয় যে, মেয়েদের মেরুদন্ডও কোমল, ছেলেদের তুলনায় নরম অর্থাৎ দূর্বল। তাদের হাড়গুলোও চিকন। তারা যখন মা হয় মেরুদন্ডের হাড় আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ এই চিকন হাড়ের ওপর একাধারে বাচ্চার ওয়েটটাকে ধারণ করতে হয়।

এদিকে বাসের মধ্যেও আবার আড়াআড়ি (ড্রাইভারের বামের পাশে) সিটে বসলে মেয়েদের জন্য মারাত্মক ক্ষত্ িসমস্ত চাপ এবং ঝাঁকি  কোমরের বা মেরুদন্ডের হাড়ের ওপর ভর করা থেকে প্রথম-এই মেরুদন্ডের ক্ষয়রোগ সৃষ্টি হয়। যা একবার হলে কোনদিনও পুরাপুরি সারেনা-ঠিক ডায়াবেটিস প্রেশার যেমন। তখন সারাজীবন তার ঐ সিটে না বসা ছাড়াও বহু নীতি মালা-মেনে চলতে হয়।

না মানলে সেটা হয় তার জন্য ভয়াবহ। এমনটা বিপদজ্জনক অবস্থানে মানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকা বোঝেনই কেমন দূর্বস্থার শামিল। আর এতে কি তার অন্যনান্য নিকটজনরা ভালো থাকে? তারাও তো পেরেশানির মধ্যেই পড়ে যায়।

কাজেই আগে থেকে সাবধান থাকলে মেয়েরা এ রোগের ঝুঁকি হতে পরিত্রাণ পাবেন। সেটা যার্নিকালে সাধারণ ইজি সিটে বসলে ওয়েস্টের ওপরের চাপ তত পরিমাণে ক্ষতি করতে পারবে না। যাবৎ জীবন ভিটামিন-ক্যলসিয়াম ট্যাবলেট খেয়েÑবাঁধা নিয়মে চলার চেয়ে সাবধান থেকে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী জীবন পাওয়া নিশ্চয়ই বহুগুণে ভাল।

ভালো নিজের জন্য, ভালো আত্মীয় স্বজনের জন্য। মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা, চাচী, ফুপু, দাদী, নানী, সুস্থ থাকলে, ভালো থাকলে, মন এবং জীবন কতটা সুখনীয় আর আনন্দের হয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

যাক এবার ভাষার মাসে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে এই আহবান জাতির কল্যাণে ব্যক্ত করলাম। একই সাথে ব্যক্ত করছি, আমি চাই না বাসের কোন হেল্পার কনডাক্টর, মহিলা সিট নাই, এই বলে ফিরিয়ে দিক। চাই না মহিলা সিট নাই বলে মহিলাকে সরিয়ে দিয়ে ছেলে তুলুক অথবা বাস ছেড়ে দিক।

একজন মেয়ে কত ঝুকিই সামলে সে বাসের নিকট বা গেট পর্যন্ত অগ্রসর হন। অথচ তাকে এই ভাবে হতাশ করা বা ফিরিয়ে দেওয়া এটা কি আদৌ শোভনীয় কাজ?

বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে সেটা কিনা মর্মান্তিক বেদনাদায়ক বা কষ্টের। এই অমানবিক কাজ আমি দেখতে প্রস্তুত নই বা দেখতে চাই না। বরং হেল্পার কনডাক্টর চিৎকার করে বলুক পুরুষ সিট নাই। পুরুষ সিট নাই বলে পুরুষকে সরিয়ে দিয়ে মহিলা তুলুক এবং বাস ছেড়ে দিক।

অবশ্যই এটা বলতে আমার কষ্টই হচ্ছে। কেননা আমি তো মায়ের জাতি। আমার পুত্রও বাইরে যায়। বাসে চলে।

আমার কোন ভাই শুভাকাঙ্খি জনও বাসে ওঠে। কিন্তু ছেলেরা ঐ কাজ করে বলেই আমি কলম ধরেছি, রাস্তায় হেনস্থা হওয়া অজানা তনয়াদের জন্য। তবে চিন্তা করছি পুরুষরা কিভাবে এতো নিষ্ঠুর হয়? এতো মর্মান্তিক নিষ্ঠুর অমার্জনীয় বেদনাদায়ক কাজ করে। ভাবতে আমার অনেক কষ্ট হয়। তেমনই অবাক হই। কারণ আমি মায়ের জাতির ওপর পুরুষের এমনটা ব্যবহার আশা করি না। আমার তো ছেলেদের কষ্ট দিতে আত্মা কেদে ওঠে, মায়া হয়।

বাবার কথা ভেবে, পুত্রের কথা ভেবে, ভায়ের কথা ভেবে। ওদের কেন এমন হয় না! ওদেরও তো মা বোন কন্যা আছে? তাদেরকে কেন মনে পরে, নারীর অপমান করতে, কষ্ট দিতে, আতে ঘা লাগে না?

যা হোক, সমাজের তনয়াদের মানে মহিলাদের অর্ধেক সিট না দিলেও এক তৃতীয়াংশ সিট চাই। এবং সেটা হেলান দেওয়া যায়, পুরা সেই সিট থেকে। এর জন্য বাম সাইডের (বাসে ওঠানামার সাথের সারি) অথবা ডান সাইডের (যেটি সাধারণত ড্রাইভারের পিছন দিয়ে) হেলান দেওয়া সিটগুলো থেকে স্বায়ীবাবে বরাদ্দ দিতে বলছি।

এটা আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ বাসের মালিক সমিতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তাদের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি। কামনা করছি মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার একনিষ্ঠ সুদৃষ্টি। তিনি কিন্তু পথের দুরুত্ব অনুসারে বাস ও মেট্রো রেলের মাধ্যমেও এর সুব্যবস্থা করতে পারেন। বিশেষ করে সংঙ্গীবিহীন পথ চলা অধিক কর্মে ব্যস্ত থাকা তৃণমূল মানুষসহ, উচ্চপদস্থ, গীতিকার এবং কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক মেয়েদের নিরাপদ পথ চলার সুব্যবস্থা করা বাংলাদেশে খুবই জরুরী প্রয়োজন।

 

লেখক পরিচিতি : সৈয়দা রাশিদা বারী

বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক