বিড়ালছানাটির কথা

বুধবার, জুন ২১, ২০২৩

 

 ।।  আরশাদ উল্লাহ্  ।।

 

নভেম্বর মাস। জাপানে কনকনে এক শীতের সকাল। পরনে দুটি মোটা জ্যাকেট, ওয়ালে এয়ার কন্ডিশনার থেকে উষ্ণ বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু তাতেও কামরা হিমশীতল। শীতে কাবু হয়ে বসে আছি। পিছনের জানালা দিয়ে সূর্যের যে আলোক রশ্মি গ্লাসের জানালা ভেদ করে ঘরে প্রতিফলিত হচ্ছে, তাতেও যে তাপ বৃদ্ধি পেয়েছে তা অনুভূত হয় না। তাপমাত্রা হিমাংকের কাছাকাছি। আমার ছেলেটি ঘরের পিছনের দরজা খুলে কি যেন খুঁজতেছিল। তখন সে তার মাকে ডেকে বলল, ‘দেখো একটি বিড়াল ছানা বসে আছে!’ সেটা দেখার জন্য দ্রুত ছেলের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে বলল, ‘দেখো সুন্দর একটি বিড়াল ছানা। আমি যখন তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন বিড়াল ছানাটি ভয় পেয়ে চলে গেছে। আমি ডানে বামে চেয়ে সেটাকে দেখতে পাই নি। বিড়াল বড় শীত কাতুরে, এ সময় মানুষের নিকট আশ্রয় চায়। বিড়ালের প্রধান খাদ্য মাছ। কিন্তু জলা থেকে মাছ ধরে খেতে পারে না। পানিতেও ভিজতে চায় না। আজ এমন একটি প্রচন্ড শীতের সকালে শিশু বিড়ালটি কোথা থেকে এসেছে ভেবে পেলাম না।

 

আমার ছেলেটি তার কর্মস্থলের নিকটবর্তি একটি ডেইরি ফার্ম থেকে একটি বিড়াল ছানা তার গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে এল। সেটাকে আদর করে পালছি। দুই মাস পরে সে আরেকটি বিড়াল ছানা নিয়ে এল। সেটা দেখে অবাক হয়ে বললাম, ‘একটি তো আছে। আরেকটি আনার কি দরকার ছিল!’

বলল, ‘ বিড়াল ছানাটি বড় দুঃখি। কর্মস্থলে কাজ করার সময় আমার পিছে পিছে হাঁটে। আমার আদর চায়। ওখানের আবহাওয়া তো হিমাংকের নিচে, শীতে মারা যেতে পারে মনে করে নিয়ে এলাম। ঘরে এখন দুটি মাদী বিড়ালছানা। তাদের জন্যে করনীয় যা করার সে করছে। পশু ডাক্তারের নিকট নিয়ে গিয়ে ভ্যাকসিন দিয়েছে, গরম পানিতে স্যাম্পু দিয়ে গোসল করিয়ে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে লোম শুকিয়ে খাবার দিয়েছে। ঘরে তাদের জন্য স্পেশ্যাল টয়লেট তৈরী করে দিল। নিয়মিত ক্যাটফুড কিনে এনে সেগুলিকে খাওয়াচ্ছে। মাসে দু’দিন স্যাম্পু দিয়ে গরম পানিতে স্নান করায়। তিন মাস পরে সে আরেকটি মর্দা বিড়ালছানা নিয়ে এল। কিছুদিন পরে সেটাকে ভ্যাসেকটমি করিয়ে এনেছে। এগুলির পিছনে সে বেশ অর্থ ব্যায় করছে। ছোটবেলা থেকে পশুপাখি আমার প্রিয়। তিনটি বিড়ালছানা ঘরে আনাতে বিরক্ত বোধ করিনি। কিছুদিন পর সেগুলির কথা ও চাহিদা বুঝতে পারি। খিদা পেলে কাছে এসে যখন কান্নাকাটি করে তার অর্থ বুঝতে পারি। খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। নির্দিষ্ট টয়লেটে যায়। বিড়াল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসে।

 

আজ আরেকটি বিড়লছানা ঘরের পিছনের দুয়ারের নিকট কোথা থেকে এসেছে জানি না। বাইরে শীতের প্রতাপ বাড়ছে।

 

সেটি হয়তো আশ্রয়ের জন্য এসেছিল। আশেপাশের বাড়িতে যারা বিড়াল পালে। সেগুলিকে যত্নকরে ঘরের ভিতরে রাখে। বাইরে যেতে দেয় না। এ পাড়াতে কোন বিড়াল বাচ্চা দিয়েছে তাও শুনিনি। তাহলে সেটা কোথা থেকে এসেছে। ঘরের সামনে রাস্তা। রাস্তা পার হওয়ার সময় গাড়ি চাপা পড়ে মরে। তাই যারা বিড়াল পালে সেটাকে ঘরের বাইরে যেতে দেয় না।

কিছুক্ষণ পর বিড়ালটির কথা ভুলে গেলাম। তার পরের দিনের কথা। সকালের নাস্তা সেরে তীব্র শীতের মাঝে মোটা জ্যাকেট পরে হাঁটতে যাই। আজও সকাল আটটায় সামনের দরজা খুলে যখন দু’পা হেঁটে গেলাম, ঠিক তখন একটি অভাবনিয় ঘটনা ঘটল যা দেখে বিবেক আমাকে নতুন এক শিক্ষা দিল। এমন ঘটনা পূর্বে কখনো ঘটেনি। সেই বিড়াল ছানাটি কোথা থেকে দৌড়ে এসে তার ছোট সামনের পা দুটি দিয়ে আমার পা জড়িয়ে ধরে নিদারুণ হৃদয় বিদারক কান্না করছে । জুতার উপর বসে আমার একটি পা ধরে মাথা ঠুকছে আর কান্না করছে। আমি পা ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম কিন্তু ব্যর্থ হলাম। জীবনে কখনো এমনটি দেখিনি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে স্ত্রীকে ডেকে বললাম, ‘দেখ, বিড়াল ছানাটি আমাকে যেতে দিচ্ছে না, এটাকে ছাড়িয়ে নাও!’

 

ইতিমধ্যে দশ মিনিটের মতো অতিক্রান্ত হয়েছে। বিড়ালছানাটির কান্না থামছে না। আমার হাঁটুতে মাথা ঘষে চিৎকার করছে। যার অর্থ, ‘আমাক দয়াকরে আশ্রয় দাও!’

অত্যন্ত সুন্দর লাল সাদা মিশ্রিত রঙের তিন মাস বয়সের বিড়াল ছানা। আমার স্ত্রীর পিছনে ছেলেটিও এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই বিড়াল ছানাটিকে কাল সকালে পিছনের দরজার নিকট দেখেছিলাম!’

বললাম, ‘ রাতে ঘরের আশেপাশেই ছিল মনে হয়। আহা, সারা রাত শীতে না জানি কত কষ্ট পেয়েছে। বিড়াল ছানাটিকে পায়ের উপর থেকে ছাড়িয়ে নিল। তারপর কার্টুন দিয়ে একটি বিড়ালের ঘর তৈরী করে ভিতরে বর্জিত কাটা কম্বলের কয়েকটি টোকরো রেখে, সেটার ভিতরে বিড়ালটিকে রেখে সামান্য ক্যাট ফুড ও ছোট বাটিতে পানি এনে রাখল। বিড়ালছানাটি কার্টুনের ভিতরে বসে রইল। হয়তো অনেক দিন খানা-পানি নেই তার। সামনে রাখা খাবারের দিকে তার আগ্রহ নেই। শুধু বাটি থেকে সামান্য পানি খেল। কার্টুনের ঘরটি দরজার বাইরে। শীতের দাপটে বিড়ালটি কম্বলের উপর চুপ করে বসে আছে। তার মনের শঙ্কা তখনো যায়নি।

 

মানুষের দয়ার উপর বির্ভরশীল এই প্রাণীটি আশ্রয়ের আশায় কাতর হয়ে আমার পা জড়িয়ে ধরে আকুতি করেছে। রাতে বিড়ালটিকে ঘরে রাখা হোক এমনটি আশা করেছিলাম। কিন্তু আমার ছেলেটি বলল যে সেটাকে ভ্যাকসিন না দিয়ে ঘরে রাখবে না। আগামিকাল পশু ডাক্তারের ক্লিনিকে নিয়ে ভ্যাকসিন দিয়ে গোসল করিয়ে ঘরে আনবে। একটি ভ্যাক্সিনের দাম পাঁচ হাজার ইয়েন।

 

দুই কিলোমিটার হেঁটে ঘন্টা খানেক পর ফিরে এসে দেখি বিড়ালটি সামান্য খাবার খেয়েছে। সারাদিন দরজার বাইরে কার্টুনের ভিতর বসে আছে। খাবার ও পানি দিয়েছে। কিন্তু ছেলে ও তার মা সেটাকে ঘরের ভিতরে থাকতে দিল না। কারণ, সেটাকে ভ্যাক্সিন দিয়ে স্টেরিলাইজ না করে ঘরের ভিতরে রাখলে দেহে কোন সংক্রমনাত্বক জীবানু থাকলে ঘরের পোষা বিড়াল তিনটি সংক্রমিত হতে পারে তা ভেবে। আমি অবশ্য ঘরের ভিতরেই রাখতাম। কিন্তু ঘরের দুজন আপত্তি করাতে বিরত রইলাম।

 

দিনের পর রাত এল। সূর্যাস্ত হওয়ার পর বরফ ছুঁয়া শীতল বাতাসের বেগ আরও বেড়েছে। বিড়ালটি শীতে কষ্ট পাবে। মনকে বুঝাতে পারলাম না। মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে গিয়ে সেটি কেমন আছে দেখার জন্য সিড়ি দিয়ে একতলায় নেমে এসে দরজা খুলে দেখলাম সেটা ঘুমায় নি। এত শীতে ঘুমাবে কেমনে। কার্টুনের ভিতর জেগে আছে। এটার কষ্ট অনুভব করলাম। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। স্টেরিলাইজ না করে সেটাকে ঘরে থাকতে দিবে না।

 

পরের দিন শিশু বিড়লটিকে পশু ডাক্তারের নিকট নিয়ে গিয়ে ভ্যাকসিন দিয়ে এনে স্নান করিয়ে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে দেহের পানি শুঁকিয়ে ঘরে এনে রাখল। বাচ্চা বিড়াল দেখে ঘরের পোষা তিনটি বিড়াল সেটাকে সহজ ভাবে গ্রহণ করল।

মনে হল জন্মের পর আশ্রয়হীন এ বিড়ালছানাটি তার কষ্টের কথা এখন ভুলে গেছে। সেটার দিকে চেয়ে ভাবছি কেমন করে সে আমার ঘরের নিকট এল। এখানে আসতে পথ দেখাল কে? দয়াময় প্রভু শত প্রকার জীব জানোয়ার সৃষ্টি করেছেন। কিতাবের কথা, ‘আল্লাহ তাদের ঋযিক দিয়েই পৃথিবীতে পাঠায়!’ কিন্তু বিড়াল যে মানুষের উপর নির্ভরশীল। একথা সবাই বুঝে না। দেশে লক্ষ করেছি বিড়াল ঘরের দরজার সামনে এসে সামান্য খাবারের জন্য মিউ মিউ করে ডাকে, কাঁদে। সে ডাকের অর্থ সবাই বুঝে না। অনেকে মারধর করে তাড়িয়ে দেয়। বহুল প্রচলিত কথাঃ ‘জীবে দয়াকরে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর!’ এ কথার মানে সবাই কি বুঝে?

 

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের নিকট ছোট প্রাণী, কুকুর, বিড়াল, ছাগল, ভেড়া ও গরু এবং আরও নাম না জানা অনেক প্রাণী আশ্রয় প্রার্থণা করে। সব মানুষ তাদের ভাষা বুঝে না। আশ্রয় দেয় না। পশুগুলির মধ্যে আমার জানামতে বিড়াল অধিকতর অসহায়। ছাগল, ভেড়া ও গরু ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু বিড়াল যে তার প্রিয় খাবার মাছ ধরে খেতে পারে না। মানুষের যৎসামান্য খাবারের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে থাকে। সব প্রাণী বাচ্চা প্রসব করে সেটাকে রক্ষা করতে যথাসাধ্য করে। অচেনা মানুষ কিংবা প্রাণী কাছে গেলে তেড়ে আসে। কিন্তু বিড়াল বাচ্চা প্রসব করে কয়েকদিন পর সে বাচ্চাকে মানুষের সামনে নিয়ে রাখে। হয়তো মা বিড়ালটি বলে, ‘দেখো আমার বাচ্চাটি অনেক সুন্দর। তোমাকে উপহার দিতে চাই!’

 

বিড়ালের এই আচরণ দেখে একথা বোধগম্য যে বিড়াল মানুষের নিকট কতোটা নির্ভরশীল। মা বিড়াল জানে যে একমাত্র মানুষের আদরে তার বাচ্চাটি বেঁচে থাকবে।

 

কয়েকদিনের মধ্যে বিড়াল ছানাটি ঘরের পোষা বিড়ালগুলির সাথে খেলাধুলা করে। এখন সে তার বিগত দঃখকষ্টের কথা ভুলে গেছে। একদিন আমার স্ত্রী টাউন কাউন্সিল অফিসে গিয়ে রিপোর্ট করল যে একটি সুন্দর বিড়ালছানা কোথা থেকে এসেছে জানিনা। আমরা আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু ঘরে এখন চারটি বিড়াল হয়ে গেল। নবাগত বিড়ালছানাটিকে দয়াকরে আগ্রহি কেউ যদি নিয়ে লালনপালন করতে চায়, এমন কোন লোক থাকলে পরিচয় করিয়ে দিলে ভাল হয়।

 

যার সাথে সে কথা বলছিল তিনি একজন মহিলা। বয়স ত্রিশের কোঠায়। তিনি আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘আমি একদিন গিয়ে বিড়ালছানাটি দেখবো। পছন্দ হলে নিয়ে আসব!’

একদিন সে মহিলাটি ক্যামেরা নিয়ে এসে সেটার ফটো নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় বললেন, ‘ বিড়াল পোষার খাঁচা ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে একদিন আসব!’

তারপর দুই সাপ্তাহ তিনি আসেন নি। আমরা বিড়ালটিকে আপন করে নিলাম। ছেলেটি তাদের যত্ন করে।

 

কখন যে দুই সাপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়ে গেল জানিনা। মহিলা বিড়ালের খাঁচা সহ একদিন তার স্বামিকে নিয়ে বিড়ালটি নিতে এলেন। তাদের দেখে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। এ বিড়ালছানাটি আশ্রয়ের জন্য আমার পা আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদেছে। আজ তারা এসেছে সেটাকে নিতে। কেন জানিনা, একথা ভেবে মনের ভিতরে আমার সত্ত্বা হাহাকার করে কেঁদে উঠল।

 

বিড়ালছানাটি আমার পায়ের কাছে এসে চুপ করে বসে আছে। তাদের দেখে মনে হয় ভয় পেয়েছে। আমার ছেলেটি তাদের বুঝাল যে বিড়ালছানাটিকে সে ভ্যাক্সিন দিয়ে অধিকতর আদর-যত্ন করে এতদিন রেখেছে। দামি ক্যাটফুড কিনে খাইয়েছে। তারা যদি এটাকে নিয়ে যথাযত ভাবে রাখেন নিতে পারেন। মহিলা বললেন যে তিনি এটার জন্য যা করণীয় সবই করবেন। চিন্তার কোন কারণ নেই।

 

বিড়ালটি তুলে নিয়ে যখন তাদের খাঁচায় রাখতে যাচ্ছিল, তখন তার প্রাণফাটা কান্না দেখে আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। কিছুতেই আমার মন চাইছিলনা যে এ শিশু বিড়ালটিকে তাদের দেই। ঘরের তিনটি বিড়াল নিঃশব্দে এ দৃশ্য নীরবে দেখছে। হয়তো তারা বুঝতে পেরেছে বিড়ালছানাটি তারা নিয়ে যাবে। কিন্তু তাদের করার যে কিছুই নাই। আমি উঠে গিয়ে বিড়ালটির মাথায় হাত রেখে বললাম, ‘হয়তো তুমি তাদের কাছে আরও অধিকতর সুখে শান্তিতে থাকবে। আমি তোমার সুন্দর ভবিষ্যৎ কামনা করি।।