মানচিত্র বদলাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন, বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে — সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

সোমবার, এপ্রিল ৭, ২০২৫

জাতির সংবাদ ডটকম।।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এখন বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য এক গভীর হুমকি। তিনি বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উপকূল ধ্বংস এবং জলবায়ুজনিত বাস্তুচ্যুতির ফলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশকে তার মানচিত্র নতুনভাবে আঁকতে হতে পারে।

 

সোমবার ঢাকার ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে (DSCSC) ” জাতীয় নিরাপত্তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব” শীর্ষক এক সেশনে বক্তৃতায় পরিবেশ উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।

 

তিনি জানান, শতকের মাঝামাঝি এক মিটার সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতা বৃদ্ধি হলে ২১টি উপকূলীয় জেলা ডুবে যেতে পারে। কোটি মানুষ গৃহহীন হবে। কৃষি ও মাছ চাষে ব্যবহৃত নদীগুলোর লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়বে।

তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন মানে শুধু মিঠা পানি লবণাক্ত হয়ে যাওয়া নয়—এটা মানে আমাদের ভূখণ্ড হারানো, জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এবং সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়া।”

 

তিনি জানান, ২১০০ সালের মধ্যে ৫২টি ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র, যেমন মালদ্বীপ, সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন। দেশের ৬৫% মানুষ প্রোটিনের জন্য মিঠা পানির মাছের ওপর নির্ভরশীল। লবণাক্ততা এই জীবনরেখা ধ্বংস করে দিতে পারে।বাংলাদেশ প্রতিবছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও খরার কারণে জিডিপির ১% ক্ষতি হারাচ্ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এ হার দ্বিগুণ হতে পারে। ফসলহানি, পানির সংকট ও গণ-বাস্তুচ্যুতি সংঘাত সৃষ্টি করবে বলেও তিনি সতর্ক করেন।

 

“বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ ডুবে গেলে, বাকি দুই-তৃতীয়াংশে প্রচণ্ড চাপ পড়বে। অস্থিরতা তখন স্বাভাবিক হয়ে উঠবে,” বলেন তিনি।

তিনি তেলসমৃদ্ধ দেশের কৌশলগত বিরোধিতা, কিয়োটো চুক্তির ব্যর্থতা ও প্যারিস চুক্তির দুর্বল বাস্তবায়ন নিয়েও সমালোচনা করেন।

বিশ্বের ৮০% গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে G20 দেশগুলো। অথচ বাংলাদেশ, জলবায়ু ঝুঁকিতে সপ্তম অবস্থানে থাকা একটি দেশ, সবচেয়ে বেশি ভুগছে।

 

তিনি জানান, ২০২৪ সাল ছিল এ যাবৎকালের সবচেয়ে উষ্ণ বছর। সমুদ্রের উষ্ণতা ও হিমবাহ গলনের হার দ্বিগুণ হয়েছে।

তিনি বলেন, “বিশ্বের নিষ্ক্রিয়তা আমাদের মতো দেশের জন্য মৃত্যুদণ্ড। সব দেশ তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করলেও তাপমাত্রা ৩ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়বে—যা মানবজাতির জন্য সহনশীল মাত্রার অনেক বেশি।” তিনি বাংলাদেশের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার কথা বলেন, যেখানে ১১টি জলবায়ু ‘চাপ অঞ্চল’ চিহ্নিত করা হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০৫০ সালের মধ্যে ২৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন।

 

তবে তিনি বলেন, শুধু অর্থ নয়, উন্নয়নের ধরণই পাল্টাতে হবে।

তিনি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর জোর দেন। যেমন, নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানি। ভবন নির্মাণেও তিনি প্রাকৃতিক বায়ুপথ ও প্রাকৃতিক আলো ব্যবহারে গুরুত্ব দেন। পরিবেশ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের আহ্বান জানান তিনি। বলেন, “আমি অভিযান চালানোর নির্দেশ দিলে তারা বলে, সারা দেশের জন্য মাত্র ৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আছেন।” এ কারণে তিনি পরিবেশ দূষণ রোধী অভিযানগুলোতে সেনাবাহিনীর সহায়তা কামনা করেন।

 

তিনি উপকূলীয় নারীদের লবণাক্ত পানির ক্ষত এবং কৃষকদের আশাহীনতা তুলে বলেন, এদের দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন পরিকল্পনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীর কাজ শুধু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নয়, বরং জলবায়ু উদ্বাস্তু ব্যবস্থাপনাও হতে পারে।

 

তিনি বলেন, “এটা শুধু গাছ বাঁচানোর লড়াই নয়—এটা দেশ বাঁচানোর লড়াই। আমরা ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক ভিন্ন বাংলাদেশ পাবে, যা আজকের মানচিত্রে কল্পনাও করা যায় না।”

 

ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের (DSCSC) কমান্ড্যান্ট মেজর জেনারেল চৌধুরী মোহাম্মদ আজিজুল হক হাজারী, OSP (BAR), SGP, ndc, psc, MPhil; ডেপুটি-কমান্ড্যান্ট কমোডোর মোস্তাক আহমেদ, (জি), NPP, ndc, psc, BN এবং চিফ ইন্সট্রাক্টর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাসান, afwc, psc সহ ২০২৫ ব্যাচের অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তাগণ এসময় উপস্থিত ছিলেন।