নিজস্ব প্রতিবেদক:
স্থায়ী আমানত বা এফডিআর-এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ৯৩ জন গ্রাহকের ২ কোটি ৩৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা জীবন বীমায় রূপান্তর করে জালিয়াতি ও প্রতারণার প্রমাণ পেয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
সম্প্রতি আইডিআরএ’র পরিচালক (আইন) মোহা. আব্দুল মজিদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি পরিচালিত একটি তদন্তে এই প্রতারণার প্রমাণ মেলে। এরসঙ্গে খোদ কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামরুল হাসান খন্দকারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এছাড়া কোম্পানির সাবেক এডিশনাল এমডি মো. জসিম উদ্দিন ও এসএএমডি মো. রবিউল ইসলামও এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
তবে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে ‘জড়িত’ থাকার প্রমাণ থাকলেও এসব কর্মকর্তারা বীমা খাতে ‘নির্বিঘ্নে’ চাকরি করছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা সংশ্লিষ্ট কোম্পানি তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এতে তারা নতুন করে প্রতারণার সুযোগ পাবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, বীমা খাত নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রচুর নেতিবাচক ধারনা রয়েছে। এই ধারনা দূর করে ইতিবাচক প্রবণতা তৈরিতে আইডিআরএসহ কোম্পানিগুলো কাজ করছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বীমার উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে কিছু মানুষ ও কোম্পানির প্রতারণার জন্য পুরো খাত নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে আরও বড় প্রতারণা হলে তা অস্বাভাবিক হবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতারণার সঙ্গে জড়িত কামরুল হাসান খন্দকার এখনো যমুনা লাইফের সিইও পদে কর্মরত রয়েছেন। তবে আইডিআরএ সম্প্রতি তার নিয়োগ নবায়নের আবেদন না মঞ্জুর বরেছে। আর মো. জসিম উদ্দিন বর্তমানে কাজ করছেন এনআরবি ইসলামিক লাইফের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
আইডিআরএ’র তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী মো. রবিউল ইসলামও অন্য একটি বীমা কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছেন। তিনি বর্তমানে কোন কোম্পানিতে কাজ করছেন তা নিশ্চিত হতে পারেনি বাণিজ্য বার্তা। তবে খাত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে মো. রবিউল ইসলাম গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে দেশ ছেড়েছেন। একটি সূত্র জানিয়েছে বর্তমানে তিনি দুবাইতে রয়েছেন। অন্য একটি সূত্রের দাবি, প্রতারণা করে গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে দেশে টিকতে না পেরে তিনি গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মালয়েশিয়াতে গেছেন। দুটি সূত্রই দৃঢ়ভাবে জানিয়েছে মো. রবিউল ইসলাম দেশে নেই।
আইডিআরএ’র তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ ও ২০২১ সালে দুই দফায় কোম্পানির চট্টগ্রাম মডেল সার্ভিস সেন্টারের ৯৩ জন গ্রাহকের কাছ থেকে ১ বছর মেয়াদি এফডিআর-এর কথা বলে ২ কোটি ৩৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা নিয়ে ১২, ১৫ ও ২১ বছর মেয়াদী পলিসি করা হয়েছে। যা বীমা আইনের পরিপন্থী। এই প্রতারণার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা মোটা অংকের কমিশন বাগিয়ে নিয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জড়িতরা প্রতি লাখে মাসিক ১০০০ টাকা ও বছর শেষে ৯ শতাংশ ইনসেনটিভ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই প্রতারণা করেছে। এর সঙ্গে মো. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী, মো. মিসির রায়হান ও মো. আতিকুর রহমান নামের তিন জনের যোগসাজশ রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যমুনা লাইফের সিইও কামরুল হাসান খন্দকার ২০২০ সালে ৪৫/২০২০ নং প্রজ্ঞাপণের মাধ্যমে কোম্পানির এফডিআর সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করে যা বীমা আইন ২০১০ এর বিধি, প্রবিধান ও আইডিআরএ’র নির্দেশনার পরিপন্থী। এছাড়াও তিনি ও কোম্পানির চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) চট্টগ্রাম সার্ভিস সেন্টার পরিদর্শনের সময় এফডিআর করার জন্য মাঠ কর্মীদের নির্দেশ দেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সিইও’র মৌখিক নির্দেশনা ও ৪৫/২০২০ নং সার্কুলারের বদৌলতে এএমডি মো. জসিম উদ্দিন ও এসএএমডি মো. রবিউল ইসলামের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কোম্পানির চট্টগ্রামস্থ সার্ভিস সেন্টারের মো. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী, মো. মিসির রায়হান ও মো. আতিকুর রহমান চট্টগ্রাম মডেল সার্ভিস সেন্টারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদেরকে লাখে মাসিক ১০০০ টাকা ও বছরান্তে অতিরিক্ত ৯ শতাংশ ইনসেনটিভ প্রদানের শর্তে ১ বছর মেয়াদী এফডিআর-এর লোভ দেখায়।
তারা কৌশলে ২ কোটি ৩৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকার পুরো তহবিলটি যমুনা লাইফের হিসাবে ট্রান্সফার করে। তারা প্রতিষ্ঠানের ৯৩ জন সদস্যের নামে ১২, ১৫ ও ২১ বছর মেয়াদী তিন কিস্তি বীমার প্রস্তাবপত্র পূরণ করে জাল মেডিক্যাল সনদপত্র যুক্ত করে অবলিখন বিভাগে দাখিল করে এবং ১,০৮,৩২,১৭৫ টাকা কমিশন হাতিয়ে নেয়।
এই কমিশনের মধ্যে ৩০ শতাংশ এফএ কমিশন বাবদ ৬৯,৮৮,৫০০ টাকা, ইউনিট ম্যানেজারের কমিশন বাবদ ২০,৯৬,৫৫০ টাকা এবং ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের কমিশন বাবদ ১৭,৪৭,১২৫ টাকা রয়েছে।
তদন্ত দলের কাছে যমুনা লাইফের মুখ নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান খন্দকার একটি লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, যমুনা লাইফের এফডিআর নামে কোনো স্কিম বা পলিসি নেই। তবে সিঙ্গেল প্রিমিয়াম বীমা পলিসি আছে যা প্রচলিত মৌখিক ভাষায় বীমা কর্মীরা এফডিআর বলে আখ্যায়িত করে।
তিনি আরও বলেন, তারা ৩ কিস্তি বীমা হিসেবে কোম্পানিতে প্রস্তাবপত্র উপস্থাপন করেন এবং কোম্পানির অবলিখন বিভাগও তাদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী ৩ কিস্তি বীমা পলিসি ইস্যু করে।
কামরুল হাসান খন্দকার বলেন, অভিযোগকারীগণ অত্যন্ত সুকৌশলে বিভিন্ন জাল কাগজপত্র তৈরি করে গ্রাহকদেরকে এফডিআর-এর নাম ভাঙিয়ে টাকা গ্রহণ করে এবং ৩ কিস্তির বীমা হিসেবে বীমা করিয়ে দেয়। বিনিময়ে তারা তাদের প্রাপ্য কমিশন কোম্পানি থেকে বের করে নেয়। মূলত তারাই প্রতারণা করে এমন ঘটনা ধাপাচাপা দেওয়ার কৌশলে বিভিন্ন জায়গায় অপপ্রচার করে অভিযোগ করেছে।
তদন্ত দলকে তিনি জানান, এ বিষয়ে তাদের বিরুদ্ধে কোম্পানি চট্টগ্রাম পাঁচলাইশ থানায় মামলা দায়ের করেছে এবং তারা কারাভোগও করেছেন এবং মামলাটি বিচারাধীন।
অভিনব এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে কামরুল হাসান খন্দকার গণমাধ্যমে বলেন, একটা প্রতারণা যে হয়েছে শুরু থেকে সেটা আমরাও বলে আসছি। বিষয়টি নিয়ে মামলাও হয়েছে। তবে আইডিআরএ’র তদন্ত দল কোন তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত করেছে আমার তা জানা নাই।
তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত কাগজপত্র আমার অফিসে আছে। অফিস উন্মুক্ত। আপনি (প্রতিবেদক) চাইলে এসে কাগজপত্র দেখতে পারেন।
মানুষের কথায় প্রতিবেদককে বিভ্রান্ত না হওয়ার পরামর্শও দেন তিনি। বলেন, পৃথিবীতে কোরআন শরীফ ছাড়া সব কিছুতেই সমস্যা থাকতে পারে।
এদিকে যমুনা লাইফের গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মো. জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, উল্লেখিত ঘটনার সাথে আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই আইডিআরএ কি প্রমাণের ভিত্তিতে আমার নাম জড়িয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়। এমনকি আইডিয়ারের কেউ আমার সাথে কখনো যোগাযোগ করেনি। কোম্পানির তদন্তে যাদের নাম আসছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কোর্টে অভিযুক্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধীন। পরিকল্পিতভাবে আমার নাম জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।