যানজটমুক্ত সিলেট মহানগর প্রসঙ্গে কিছু প্রস্তাব

বুধবার, নভেম্বর ২৬, ২০২৫

।। শহীদ আহমদ খান।।

সিলেট শহর বর্তমানে ‘মহানগর’ ও ‘বিভাগীয়’ শহর। এর পূর্বে ছিল শতাব্দী প্রাচীন জেলা ও পৌরশহর। তৎপূর্বে ছিল গৌড় রাজ্যের রাজধানী শহর। সিলেট শহরের যানজটের মূল কারণ হচ্ছে এর প্রাচীনত্ব। এই শহরের যখন গোড়াপত্তন হয় তখন থেকে কয়েকশ বছর পর্যন্ত আধুনিক কোন যানবাহন ছিলনা। যানবাহন বলতে ছিল স্থলপথে পালকি, ঘোড়া ও গরু-মহিষের গাড়ি এবং জলপথে নৌকা। তখন শহরে মাত্র কয়েকটি মহল্লায় খুব কমসংখ্যক লোকের বাস ছিল। বর্তমানে এই শহরের পরিধি বেড়েছে অনেক। লোকসংখ্যা বেড়েছে কয়েক হাজার গুণ। সে পরিমাণে রাস্তা বাড়ে নাই। আধুনিক নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, ‘একটি আদর্শ শহরের চার ভাগের এক ভাগ রাস্তা থাকা অপরিহার্য।’ কিন্তু সিলেটের মূল শহরে তা নেই এবং করাও সম্ভব নয়।

স্বাধীনতা উত্তর জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা প্রথম রাস্তা সম্প্রসারণের উদ্যেগ নেন। এর পর আরো কয়েকবার রাস্তা সম্প্রসারণ করা হয়েছে কিন্তু সমস্যার তেমন সমাধান হয়নি, হবেও না।

১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্বীনব্রীজ দিয়ে মানুষ ও সকল ধরনের যানবাহন চলাচল করেছে। সেই যানবাহনে পার হয়ে মানুষ বর্তমানে যেখানে যাচ্ছে তার বাইরে আসামের শিলচর, করিমগঞ্জ, গুয়াহাটি, মেঘালয়ের শিলং ইত্যাদি ভারতীয় অঞ্চলেও যাতায়াত করেছে। ক্বীনব্রীজের প্রায় ৫০ বছর পর এরশাদ সরকার করেন কদমতলী দিয়ে ২য় সুরমা সেতু। এরপর হয়েছে মুরাদপুর বাইপাস সেতু, কাজীর বাজার সেতু এবং তেমুখী বাইপাস সেতু। ক্বীনব্রীজের প্রায় ৫০ বছর পর একটি এবং পরের ৩০ বছরের মধ্যে আরো ৩টি (মোট ৪টি) সেতু নির্মিত হয়েছে ব্যাপক চাহিদার কারণে কিন্তু রাস্তা কী ৪ গুণ সম্প্রসারিত হয়েছে ? না, হয়নি, সম্ভবও নয়। তাহলে কী নাগরিক জীবন যানজটে থেমে থাকবে।’ না, থামাও সম্ভব নয়। তাহলে উপায় কী ? উপায় একটাই জনকল্যাণ পর্যালোচনা করে পরিকল্পনা প্রণয়নও বাস্তবায়ন।

সিলেট শহরে বর্তমানে তীব্র যানজট হয় মেন্দিবাগ- সোবহানীঘাট- বন্দর, টিলাগড়- নাইওরপুল- বন্দর, বন্দর- জিন্দাবাজার- আম্বরখানা রোডে। এসব রোডের সাথে সংযুক্ত আরো কয়েকটি রোডেও যানজট হয়। এই যানজটের কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, অতিরিক্ত যানবাহন, অপরিসর রাস্তা, রাস্তার উপর অবৈধ গাড়ি পার্কিং এবং ফুটপাতে ব্যবসা ইত্যাদি।

বন্দর বাজারের দিকে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপের প্রধান কারণ হচ্ছে জেলা প্রশাসন, জেলা ও মহানগর আদালত, সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রধান ডাকঘর, কতোয়ালী থানা, বাংলাদেশ ব্যাংক, জেলা ও বিভাগীয় শিক্ষা অফিস, ফায়ার ব্রিগেড, জেলা ও সদর সাব রেজিস্টার অফিস, স্টেশন ক্লাব, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ি, রাজা জিসি হাই স্কুল, দুর্গাকুমার পাঠশালা, পাইলট হাইস্কুল, অগ্রগামী বালিকা স্কুল ও কলেজ, ডায়াবেটিক হাসপাতাল, সার্কিট হাউস, সকল ব্যাংক- বীমার শাখা, সোবহানীঘাট ও নাইওরপুলে কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ওসমানী শিশুপার্ক ও জাদুঘর , কয়েকট মসজিদ সহ অন্যান্য অফিস আদালত বন্দর বা বন্দরের আশেপাশে অবস্থিত। তা ছাড়া সিলেটের ব্যবসার আড়ৎ কালিঘাট, মহাজন পট্টি, লালদিঘির পাড়, হকার মার্কেট, হাসান মার্কেট, করিমুল্লাহ সহ আরো অনেক মার্কেট ও দোকান রয়েছে। বন্দর বাজার থেকে পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, নর্থ ইস্ট ইউনির্ভাসিটি বাংলাদেশ, ওসমানি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মদন মোহন কলেজ, অন্যান্য মার্কেট এবং আবাসিক এলাকায় যাতায়াতও এদিকে।

এসব অফিস- আদালতের কর্মকর্তা- কর্মচারী, হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, রোগী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক, কর্মকর্তা- কর্মচারির ব্যক্তিগত ও অফিসের গাড়ি, এম্বুলেন্স, মালামাল পরিবহনের ট্রাক, পিকআপ ভ্যানগাড়ি, ঠেলাগাড়ি, মটর সাইকেল, সিএনজি, রিক্সা ইত্যাদি রবি থেকে বৃহস্পতি এই ৫ দিন উক্ত এলাকায় সমাগম বেশি হওয়ায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। শনিবারে অফিস- আদালত, স্কুল কলেজ বন্ধ থাকে তাই যানজট কম হয় বা থাকে না। শুক্রবারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ থাকে ফলে রাস্তা একেবারে ফাঁকা থাকে।

প্রশাসন যানজট কমানোর জন্য স্থানীয় ট্রাক, পিকআপ সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা এবং আন্তঃজেলা ট্রাক রাত ১০টা পর্যন্ত শহরে গমনাগমন বন্ধ রেখেছেন, তাতেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, হবেও না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য এই এলাকা থেকে কিছু প্রতিষ্ঠান সরানো এবং ট্রাকের রুট পরিবর্তন একান্ত জরুরী। মূল অফিস- আদালত বা ব্যবসা প্রতিষ্টান সরানো সম্ভবও নয়, কাম্যও নয়। তাই জনকল্যাণ পর্যালোচনা করে কোন্ কোন্ প্রতিষ্ঠান সরালে ক্ষতি কম ও লাভ বেশি হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

ইতিমধ্যে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত কারাগার বাদাঘাটে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কারাগারের উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমের ওয়াল ভেঙ্গে রাস্তা সম্প্রসারণ করা সম্ভব।

হাসান মার্কেটের কারণে বন্দর বাজারে তীব্র যানজট হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত গোবিন্দ চরণ পার্ক ছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী ঐতিহাসিক স্থান। ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত জেলা প্রশাসক হাসান সাহেব, এই পার্ক ভেঙ্গে কেন মার্কেট করলেন সে প্রশ্নও আছে। কারণ তখন মার্কেট করার মত যথেষ্ট জায়গা এর আশেপাশে ছিল, আজও আছে। যাই হউক বর্তমান বাস্তবতায় হাসান মার্কেটের একটা বিহিত করা সময়ের দাবি। হয় হাসান মার্কেটের নিচ খালি রেখে উপরে বহুতল মার্কেট নির্মাণ করে অথবা রংমহল টাওয়ারের পূর্ব পাশে জেলের পরিত্যক্ত জায়গায় বা মূল জেলের এক কোণায় কিছু জায়গায় বা নতুন হকার মার্কেটে বহুতল মার্কেট নির্মাণ করে হাসান মার্কেটের ব্যবসায়ীদের পূর্ণবাসন করে যানজট কমানো যায়।

জনসংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও সেভাবে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কিন্তু কালিঘাট, মহাজনপট্টি, লালদিঘির পার এলাকায় জায়গার অভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না।
ব্রিটিশ আমলে (১৮৩৬ সালে) প্রতিষ্টিত পাইলট হাই স্কুল তখন খুবই মনোরম পরিবেশে স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এখানে লেখাপড়ার কোনো পরিবেশ নেই। নেই বিদ্যালয়ে আসা যাওয়ার নিরাপদ রাস্তা। চতুর্দিকে বাজারের কোলাহল, যানবাহনের জট, সার্কিট হাউসে ভিআইপিদের আগমনে অনেক সময় রাস্তা বন্ধ থাকে। এই বিদ্যালয়ের ৯৫% শিক্ষক ও শিক্ষার্থী আসেন অনেক দূর দূরান্ত থেকে। ফলে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকদের পোহাতে হয় নিদারুন দূর্ভোগ। যদি পাইলট হাইস্কুলটি শিক্ষা বান্ধব পরিবেশে স্থানান্তর করা হয় তাহলে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকরা দূর্ভোগ মুক্ত হবেন। এই এলাকাও যান ও জনজটমুক্ত হবে। অন্যদিকে বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত জমি ভাড়া বা লীজ বা মার্কেট নির্মাণ করে বিদ্যালয় বা সরকার আর্থিক ভাবে লাভবান হতে পারেন। অন্যদিকে ব্যবসা সম্প্রসারনের সুযোগ হবে, যানজটও কমবে।

ট্রাকের বিকল্প রুটের জন্য সার্কিট হাউসের সামনে থেকে কালিঘাট, ছড়ারপার হয়ে মেন্দিবাগ পর্যন্ত নদীর পাড় দিয়ে একটি রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমান সাহেবের। এই রাস্তাটি নির্মিত হলে কালিঘাটের ট্রাক এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করবে, ফলে বন্দর বাজার বা এর আশেপাশে যানজট হবে না। বিকল্পে মেন্দিবাগ- ছড়ারপার হয়ে বা মেন্দিবাগ- চালিবন্দর- দিঘি- মহাজনপট্টি হয়ে নতুন রাস্তা তৈরি বা সম্প্রসারণ করে ট্রাক চলাচলের রাস্তা করা যেতে পারে বা ক্বীনব্রীজের পূর্ব পাশে আরেকটি ব্রীজ নির্মাণ করে সেই ব্রীজের উত্তর মাথা কালিঘাটে নামানো যেতে পারে বা কাজীর বাজার সেতুর উত্তর প্রান্ত থেকে তেলিহাওর- সুরমা মার্কেট- কালিঘাট পর্যন্ত একটি ওভার ব্রীজ করা যেতে পারে বা কদমতলী বাস টার্মিনাল ও ঝালোপাড়ার পশ্চিম পাশ দিয়ে কালিঘাট-লালদিঘিরপার পর্যন্ত একটি ব্রীজ নির্মাণ করা যেতে পারে। ফলে মূল শহরে আর যানজট হবে না।

মেন্দিবাগ থেকে সোবহানীঘাট- নাইওরপুল- বন্দর পয়েন্টে বিশেষ করে বিকাল থেকে রাত অবধি যানজটের অন্যতম কারণ হচ্ছে নামিদামি কয়েকটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এই এলাকায় প্রতিযোগিতা করে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠছে। কেউ কেউ এই এলাকায় যানজটের কারণ হিসেবে কাচাঁবাজারকে দায়ী করছেন। আসলে তা ঠিক নয়। কারণ কাচাঁবাজারে মালামাল আসে গভীর রাতে আর বিক্রি শুরু হয় রাত ৪/৫ টায়, শেষ হয় সকাল ৮/৯ টায়। তখন শহর প্রায় ফাঁকা থাকে। কাচাঁবাজার নিত্যপণ্যের বাজার। এর সাথে সর্বসাধারণের স্বার্থ জড়িত। জনস্বার্থে একে ভোক্তার হাতের কাছে রাখতে হবে। অপর দিকে হাসপাতাল, ক্লিনিক ইত্যাদি হওয়া উচিত নিরিবিলি ও যানজটমুক্ত পরিবেশে। যেখানে হাসপাতাল সেখানেই রোগী। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের অনুমতি দেওয়ার সময় রোগীর কল্যাণ ও জনদূর্ভোগ পর্যালোচনা করা উচিত।

বর্তমানে ক্বীনব্রীজ দিয়ে শুধুমাত্র মানুষ চলাচল করেন। ফলে ক্বীনব্রীজের সামর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার হচ্ছে না। পূর্বে যেসব রিক্সা ক্বীনব্রীজ দিয়ে চলাচল করত বর্তমানে সেগুলো কাজীর বাজার সেতু বা ২য় সুরমা সেতু দিয়ে যাতায়াত করে। ফলে বন্দর বাজার থেকে শেখঘাট জিতুমিয়ার পয়েন্ট পর্যন্ত এবং নাইওরপুল, সোবহানীঘাট, মেন্দিবাগ পর্যন্ত যানজটের সৃষ্টি করে। তাই ক্বীনব্রীজ দিয়ে রিক্সা চলাচলের অনুমতি জনস্বার্থে কাম্য।

শহরে যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ কমানোর জন্য টাউন বাস সার্ভিস সুলভ এবং সহজ করা, কিছু কিছু রাস্তায় রিক্সা নিষিদ্ধ করা, অবৈধ পার্কিং এর জন্য মোটা অঙ্কের জরিমানা আরোপ করা যেতে পারে।
ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের বহুবার উচ্ছেদ করা হয়েছে কিন্তু যেই লাউ সেই কদু। এবারের উচ্ছেদও মনিটরিং একটু হালকা হলেই তথৈবচ হবে। তাই হকারদের উচ্ছেদের পিছনে সময় নষ্ট না করে তাদের কাছ থেকে যারা কেনাকাটা করেন তাদেরকে শাস্থি ও জরিমানার আওতায় আনেন, ক্রেতা শুন্য হলেই হকার আর রাস্তায় পসার নিয়ে বসবে না।

হকারের উপদ্রব বন্দর ও জিন্দাবাজারে বেশি। তার কারণ সারা শহরের মানুষ শাক-সবজি, ফল- মূল, মাছ- মাংস ইত্যাদি কেনার জন্য রিক্সা, সিএনজি ভাড়া দিয়েও এখানে আসেন। কারণ এখানে কম দামে সব কিছু পাওয়া যায়। যদি শাহজালাল উপশহর, হাউজিং এস্টেট বা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পরিকল্পিত কাচাঁবাজার, মাছ- মাংস, ডিমের দোকান ইত্যাদি থাকত এবং একই দামে বিক্রি হত, তাহলে সারা শহরের মানুষ ও হকার বন্দর ও জিন্দাবাজারে জড়ো হতেন না। তাই এব্যপারে পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরী।

উপরোক্ত প্রস্তাব গ্রহণ ও বাস্তাবায়ন করা গেলে আশা করা যায় যানজটমুক্তি ঘটবে। সংশ্লিষ্টরা বিবেচনা করে দেখতে পারেন।

লেখক পরিচিতি: শহীদ আহমদ খান
লেখক, কলামিস্ট