রমজান আত্মসংযমের প্রশিক্ষণের মাস: মুফতী মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী

শুক্রবার, মার্চ ২৪, ২০২৩

 

জাতির সংবাদ ডটকম ডেস্ক।।

অজস্র-অফুরন্ত রহমত, বরকত ও নাজাত নামক পণ্য ও কল্যাণের বার্তা নিয়ে মাহে রমজান মানুষের মাঝে প্রতি বছর শুভ আগমন করে। মহান আল্লাহ এ মাসটিকে বহু ফজিলত ও মর্যাদা দিয়ে অভিষিক্ত করেছেন। যারা সিয়াম সাধনায় আত্মসংযমের মাধ্যমে রমজানে এই পন্য ক্রয় করে তারাই কামিয়াবি লাভের মধ্য দিয়ে আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করে থাকে। রমজান আত্মসংযমের প্রশিক্ষণের মাস।

রমজান কয়েকটি কারণেই বিশেষ মর্যায় মর্যাদাবান। রমজানেই মানবজাতির জীবন বিধান মহান শ্বাশত কুরআনমজিদ নাযিলের সূচনা হয়। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেন, রমজান মাসেই নাজিল হয়েছে আল কোরআন। এটা মানবজাতির জন্য জীবনযাপনের বিধান এবং এমন সুস্পষ্ট উপদেশ, যা সঠিক ও সত্যপথ প্রদর্শন করে এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরে-(-সূরা আল বাকারা: ১৮৫)। লাইলাতুলকদরের মতো গুরুত্বপূর্ণ রজনীও রয়েছে এমাসে। এমাসে আছে সাহরি, ইফতার, তারাবিহ, ইতিকাফ, লইলাতুল কদর, ফিতরা ও ঈদুল ফিতর। নফল ইবাদতকে ফরজের মর্যাদায় এবং একটি ফরজকে সত্তরটি ফরজের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রতিটি নেকী সত্তর গুণে উপনীত। ফজিলতপূর্ণ এমাসে পাপ থেকে মুক্তির জন্য আত্মশুদ্ধির তাকওয়া অর্জনের রয়েছে নানাহ ইবাদতের ক্ষেত্র। তাছাড়াও মনের কালিমা ও পঙ্কিলতা দূর করে এই মাস মানুষকে অন্যায়-অপরাধ থেকে বিরত রাখে সুশৃঙ্খলভাবে চলার শিক্ষা দেয়। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ও আত্ম-অহংবোধ ভুলে গিয়ে সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী সমাজ গড়ার প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে রমজান। তাকওয়ার অনুপম প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে মুসলিমদের সত্যিকার মু’মিন বনার সহায়ক রমজানুল মোবারক। আল্লাহর সোবহানাহু তা’য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের সব প্রকার নাফরমানি কাজ থেকে দূরে থাকার নামই ‘তাকওয়া’। তাকওয়া অর্জনই প্রধান উদ্দেশ্য: সিয়াম ছাড়া অন্য ইবাদাত তাকওয়া সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। রোজা বান্দার মনে আল্লাহর ভয়-ভীতি সৃষ্টি করে থাকে। আল্লাহর কাছে বান্দার মান-মর্যাদা নির্ধারণের একমাত্র উপায় কিন্তু তাকওয়া। তাকওয়াই মানুষের মনে সৎ ও মানবিক গুণাবলি সৃষ্টি করে। যার ফলে মানুষের মানসিকতার মধ্যে অপরাধপ্রবণতা অনেকটাই কমে যায়।

 

সিয়াম পালন তথা রোজা ফরজ। এটি ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘‘হে ঈমানদারগণ!  তোমদের ওপর রোজা ফরজ করে দেয়া হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার। (সূরা আল-বাকারাহ : ১৮৩) ‘‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে রোজা পালন করে।’’ (সূরা আল-বাকারাহ : ১৮৫) হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের বিশ্বাসে রমজানের রোজা রাখে তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি রমজানের রাত্রি জাগরণ করে ইবাদতে লিপ্ত থাকে তারও পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি শবেকদরের রাতে ঈমান ও একিন সহকারে ইবাদত করে তারও সকল গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেন (বুখারী ও মুসলিম)। রোজা একটি ধৈর্যের প্রশিক্ষণ, ব্যক্তিজীবন গঠন, সমাজের উন্নয়নে, মানবতার সেবা, দ্বীনি দায়িত্ব পালনে পাহাড়সম বাধা মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন অপরিসীম ধৈর্য, সেই জন্য রাসূল (সা) এ মাসকে ধৈর্যের মাস হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা সবরের মাস আর সবরের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত।’ অন্য একটি হাদিসে বলা হয়েছে, হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেছেন, কেবল আহারাদি থেকে বিরত থাকার নাম রোজা নয়। অশ্লীল কথাবর্তা ও অশালীন আলোচনা থেকে দূরে থাকাই আসল রোজা। অতএব হে রোজাদার! যদি কেউ তোমাকে গালি দেয় বা তোমার সাথে অভদ্রতা করে তাহলে তাকে বলো : আমি রোজাদার। (ইবনে খোযায়মা ও ইবনে হিক্বাম)

 

রোজা মানুষকে প্রকৃত ধার্মিক গড়ার সিঁড়ি হিসেবে কাজ করে। সাম্য, মৈত্রী, একতা, ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি, শৃঙ্খলা, একনিষ্ঠতা, নিয়মানুবর্তিতা প্রভৃতি মানবীয় মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়। ধনী-দরিদ্র, আমির-ফকির যে একই ভ্রাতৃত্বের অন্তর্গত এবং একের প্রতি অন্যের যে দায়িত্ব আমরা তা এই রমজান মাসেই অনুভব করতে পারি। রোজার ক্ষুধার মাধ্যমে দারিদ্র ক্লিষ্ট মানুষের নিত্যদিনের ক্ষুধার কষ্ট আমরা এই রমজান মাসেই উপলব্ধি হয়। এই উপলব্ধি হতে দরিদ্র মানুষের প্রতি সহানুভূতি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য করে একত্রে ইফতার, দীর্ঘ তারাবি নামাজ, সেহির—এ সবকিছুর মধ্য দিয়ে একজন রোজাদার ব্যক্তি মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। হজরত রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল আর মিথ্যা কথা ও খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারল না, তার না খেয়ে থাকার প্রয়োজন আল্লাহ তা’য়ালার কাছে নাই। (অর্থাৎ তার রোজা আল্লাহ তা’য়ালা কবুল করবেন না-(সহিহ বোখারি)।

মূলত উম্মতে মুহাম্মদীর নৈতিক চরিত্র উন্নত করে সাহাবায়ে কিরামের মতো আদর্শ জীবন গঠন করার প্রশিক্ষণ এ মাসেই গ্রহণ করতে হয়।

 

প্রতি বছরই আত্মশুদ্ধি ও নৈতিকতার সুমহান বার্তার পরিক্রমায় আমাদের মাঝে রমজানের উপস্থিতি। সুতরাং, যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে বিরত থেকে ভালো কাজ করতে পারলেই রোজা পালন সফল ও সার্থক হবে। এভাবে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অর্জিত প্রশিক্ষণ দ্বারা নিজেদের একজন সৎ ও খোদাভীরু নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে। রোজার শিক্ষা নিয়ে তাকওয়ার গুণাবলি অর্জনের মধ্য দিয়ে মানুষ ইহকালীন কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তি লাভ করতে পারে। মাহে রমজানের এ শিক্ষা যদি বাকি ১১ মাস কাজে লাগানো যায়, তাহলে পৃথিবীতে এত অশান্তি ও অনাচার থাকতে পারে না। যেমনভাবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে সংশোধিত হলো, সেই সফলকাম হলো।’ (সূরা আল-আ’লা, আয়াত-১৪) মাহে রমজান মানুষকে ঐশ্বরিক গুণে গুণান্বিত হওয়ার এবং কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার শিক্ষা দেয়। রোজাদার একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতি রিপু দমনপূর্বক রোজা পালন করেন। রোজার মাধ্যমে মানুষ পরমতসহিষ্ণুতা ও হতদরিদ্রের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতা, পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতার শিক্ষা লাভ করেন। রোজা মানুষের ভেতর ও বাহির—দুই দিকের সংশোধন করে। মানুষের বাতেন বা ভেতরের অবস্থা পরিবর্তন করা, অর্থাৎ আলোকিত করা এবং তাঁর স্বভাব, চরিত্র, আচার-আচরণ সংশোধনপূর্বক প্রকাশ্যভাবে সুন্দর করে গড়ে তোলা রোজার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে রোজা মানুষকে পার্থিব লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরচর্চা, পরনিন্দা, মিথ্যাচার, প্রতারণা, অতিরিক্ত সম্পদ অর্জনের আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখে আত্মসংযমের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে। রোজা মানুষকে আত্মনিয়ন্ত্রণ, মিতাচার, মিতব্যয়িতা ও পারস্পরিক ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। তাই মাহে রমজানে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সবাইকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার দৃপ্ত শপথ নিতে হবে।

 

এ মাসের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ সাধন করা সম্ভব। অতি মহিমান্বিত ও পবিত্র মাস : মহান আল্লাহ মানবজাতিকে সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হননি; সৃষ্টির সাথে সাথে সত্য প্রদর্শনের জন্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। তাদের মাধ্যমে তিনি তার দিকনির্দেশনা বা বিধানও পাঠিয়েছেন কোরআনু কারীম। এ কোরআন পবিত্র রমজান মাসে নাজিল হয়েছে। অন্য সকল আসমানী কিতাবও এ পবিত্র মাসে নাজিল হয়। আল্লামা ইবনে কাছির বলেন “এটা সেই মাস যে মাসে নবীগণের ওপর আল্লাহর কিতাবসমূহ নাজিল করা হয়েছে।” অতএব, রমজান মাস শুধু কোরআন নাজিলের মাস নয়; সকল আসমানী কিতাব নাজিলেরও মাস। এ মাসেরই ৬ তারিখে মুসা (আ:) এর ওপর তাওরাত, ১৮ তারিখে দাউদ (আ:) এর ওপর যবুর, ১৩ তারিখে ঈসা (আ:) এর উপর ইনযিল এবং শেষ ১০ দিনের কোন এক বিজোড় রাতে আল কোরআন অবতীর্ণ হয়। কোরআন নাযিলের এ রাতকে ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘কদরের রাত’ বলা হয়। শুধু তাই নয় এ মাসের ২য় হিজরির ১৭ই রমজান বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং মুসলমানরা বিজয়ী হয়, ৮ম হিজরির ২০ শে রমজান মক্কা বিজয় হয়, রমজানের প্রথম রাত্রি হযরত ইবরাহিম আ:-এর ওপর সহিফা নাজিল হয়, ১৩ই রমজান আমর বিন আসের নেতৃত্বে জেরুসালেম জিয় হয়, রমজান মাসেই হযরত সুমাইয়া নির্মমভাবে শহীদ হন, ৯২ হিজরিতে রমজান মাসেই তারেক বিন জিয়াদ কর্তৃক স্পেন বিজয় হয়, রমজান মাসে মুসলমানদের পবিত্রস্থান বায়তুল  মোকাদ্দাস বিজয় হয়। আর এ কারণে মাসটি অতি মহিমান্বিত। মু’মিন বান্দার জীবনে বছরের মধ্যে রমজান মাসটিই এক দুর্লভ সুযোগ এনে দেয়। রমজান আমল করার মাস, এর প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ অনুগ্রহ লাভের বিরাট সুযোগ। রমজান মাসে বান্দাহ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে অনেক নৈকট্য অর্জন করতে পারেন। রোজাদারের মর্যাদা উল্লেখ করে হাদিস শরিফে রাসূল (দঃ) এরশাদ করেছেন, ‘রোজাদারের নিদ্রা ইবাদতের সমতুল্য, তার চুপ থাকা তসবিহ পাঠের সমতুল্য, সে সামান্য ইবাদতে অন্য সময় অপেক্ষা অধিকতর সওয়াবের অধিকারী হয়। নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, যারা রমজান মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রোজা পালন করেছে, তারা ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে, যেদিন তাদের মাতা তাদের নিষ্পাপরূপে প্রসব করেছিলেন।

 

এ মাস দো’য়া কবুলের মাস, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “(রামাদানের) প্রতি দিন ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) আল্লাহর কাছে বহু বান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাদের প্রত্যেক বান্দার দো’আ কবুল হয়ে থাকে (যা সে রমযান মাসে করে থাকে)।” (সহীহ সনদে ইমাম আহমদ কর্তৃক বর্ণিত, হাদিস নং ৭৪৫০) রোজার পুরস্কার আল্লাহ স্বয়ং নিজে প্রদান করবেন : একটি হাদিসে কুদসিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- আল্লাহ বলেন, “বনি আদমের সকল আমল তার জন্য, অবশ্য রোযার কথা আলাদা, কেননা রোযা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার দেবো।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮০৫) রোযা রাখা গোনাহের কাফফারা স্বরূপ এবং ক্ষমালাভের কারণ : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমজান মাসে রোযা রাখবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৯১০) । সিয়াম রোযাদারের জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: “কিয়ামতের দিন রোযা এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে,  ‘হে রব! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির কামনা হতে বাধা দিয়েছি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন।’ কুরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুমাতে দেয়নি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। ফলে এ দুয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ (মুসনাদ, হাদিস নং ৬৬২৬) রোযা জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তিলাভের ঢাল : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “যে বান্দাহ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোযা রাখে আল্লাহ তার ও জাহান্নামের মধ্যে ৭০ বছরের দূরত্ব  তৈরি করেন।” (সহীহ বুখারী, হাদিস) মাসের রোযা রাখা একাধারে বছরের দশ মাস রোযা রাখার সমান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, রামাদানের রোযা দশ মাসের রোযার সমতুল্য, ছয় রোযা দুই মাসের রোযার সমান, এ যেন সারা বছরের রোযা।

 

রোজা পালনের মাধ্যমে মানুষ নিজের নফস বা অন্তঃকরণকে পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। মাহে রমজানের এ শিক্ষাকে সবর বা ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা বলা হয়। রোজাদার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ক্ষুধার্ত থাকেন এবং অনাহারী, অর্ধাহারীদের সঙ্গে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। তাই মাহে রমজান মানুষকে দুঃখীজনের পাশে দাঁড়াতে শিক্ষা দেয়, সৃষ্টিজগতের প্রতি উদার, সহমর্মিতা ও দয়াশীল হতে শিক্ষা দেয়। মাহে রমজানের শুভদ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায়; শুধু রমজান মাসে নয়, সমগ্র জীবনে যদি সবাই দুঃখীজনের পাশে থাকি, তবে মানবসমাজে আর কোনো রকম অসাম্য ও বর্ণবৈষম্য থাকতে পারে না। রোজা পালন করে মানুষ ইবাদত-বন্দেগির দ্বারা আল্লাহর অশেষ নিয়ামতের শোকর আদায় করতে শেখে এবং শরিয়তের বিধিবিধানের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে। এভাবে যদি কেউ সমস্ত কামনা-বাসনা ত্যাগ করে ঐকান্তিকতার সঙ্গে রোজা রাখে এবং ধৈর্যের সঙ্গে যাবতীয় কষ্ট সহ্য করে, তাহলে সে অবশ্যই সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারে। তাই রোজাদারের জন্য আল্লাহ পাক নিজ হাতে সওয়াব প্রদানের সুসংবাদ দিয়েছেন। মাহে রমজানকে তাকওয়া অর্জন, নৈতিক চরিত্র গঠন ও প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। সিয়াম সাধনার দ্বারা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া-মমতা, আন্তরিকতা, দানশীলতা, বদান্যতা, উদারতা, ক্ষমা, পরোপকারিতা, সহানুভূতি, সমবেদনা প্রভৃতি সদাচরণ জন্মায়। মাহে রমজানের যে মহান শিক্ষা, তা গ্রহণ করে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রোজা যে পরহেজগারি শিক্ষা দেয়, সে অনুযায়ী মানবজীবন পরিচালিত করা উচিত। মাহে রমজানে যে সংযম সাধনার শিক্ষা রয়েছে, আমাদের জাতীয় জীবনে তার যথার্থ প্রতিফলন ঘটাতে হবে। প্রকৃতপক্ষে মাহে রমজান মুসলমানের ব্যক্তিগত জীবন থেকে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনসহ সর্বস্তরে অনুশীলনের দীক্ষা দিয়ে যায়। তাই আসুন, রোজার প্রকৃত শিক্ষা ও উদ্দেশ্যের প্রতি যত্নবান হয়ে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নিজেদের মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করি, মানবিক গুণাবলিতে জীবনকে আলোকিত করি; তাহলে মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা অর্থবহ হবে।

 

পবিত্র মাহে রমযানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সর্বজনীন-কল্যাণবোধের শাশ্বত চেতনায় সকল অকল্যাণর মানবতাবিরোধী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মানবতাকে জয় করার পথে আমাদের এগিয়ে নিক। রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লামার সদকায় আল্লাহ আমাদের সকল আমল (সৎকর্ম) কবুল করুন এবং আমাদের সবাইকে আরো উত্তম আমল করার তাওফিক দান করুন-আমীন।

 

লেখক: প্রধান সমন্বয়ক, বাংলাদেশ সোস্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম।মোবাইল-০১৮১৯০৪৩৮৩৭