জাতির সংবাদ ডটকম।।
শীতে কিছু রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। রোগ যাই হোক না কেন, শীতের সময়ে সর্দি-কাশি হবেই। তবে সর্দি-কাশির সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু রোগ হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও আইসিডিডিআরবি সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেনের।
তিনি বলেন, ‘শীতে অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, খুসকি, খোসপাঁচড়া, হাড়ের রোগ, ডায়বেটিসসহ নানা ধরনের শারীরিক সংকট দেখা দিতে শুরু করে। শীত আসার শুরু থেকেই মূলত সমস্যাগুলো দেখা দেয়। এগুলো সংকেত। প্রকৃতি আপনাকে প্রারম্ভিকভাবে সতর্ক করে দিচ্ছে। তাই শীতে যেসব রোগের প্রকোপ বা প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায় সেগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি।’
তাহলে শীতের ব্যাধিগুলো কী কী? আর এই ব্যাধিগুলোর প্রতিরোধ বা প্রতিকারই কেমন হতে পারে? এ বিষয়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সাজানো হয়েছে এই প্রতিবেদনটি।
নিউমোনিয়া : শীত এলেই নিউমোনিয়ার প্রকোপ যায় বেড়ে। শীতের সময় ঠাণ্ডা পানির সংস্পর্শে থাকা এবং শরীরকে পর্যাপ্ত উষ্ণতা না দেওয়ার ফলে শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ থেকে নিউমোনিয়া হয়। বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া থেকে নিউমোনিয়া হতে পারে। তবে শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠরা এই রোগে কাবু হন বেশি।
শিশুদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া ভয়াবহ। শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ থেকে শিশুর স্বাস্থ্য ভয়াবহ দিকে মোড় নিতে পারে। আর বয়স্কদের মধ্যে যাদের মেয়াদি রোগ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও এই রোগ ঝুঁকিপূর্ণ। মেয়াদি রোগ বলতে ডায়াবেটিস, কিডনি সংক্রমণ ইত্যাদি। নিউমোনিয়া প্রতিরোধের এবং প্রতিকারের ক্ষেত্রে কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো:
প্রতিকার/প্রতিরোধ
নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখে সন্দেহ হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক সঠিক মাত্রায় সেবন করতে হবে।
শিশুদের যথাসময়ে ভ্যাক্সিন দেওয়াতে হবে।
শরীরে শক্তি জোগায় এমন খাবার খাওয়াতে হবে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় অর্থাৎ ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে।
ঠাণ্ডা পানির সংস্পর্শ থেকে শিশু ও বৃদ্ধদের যতটা সম্ভব দূরে রাখতে হবে।
শীতের উপযোগী গরম কাপড় ও পোশাক পরাতে হবে।
বেশি মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা ভালো।
ফ্লুতে আক্রান্ত বা অসুস্থ কারো থেকে দূরে থাকুন।
হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন ও নিজেকে জীবাণুমুক্ত রাখুন।
চুলা, কয়েল ও সিগারেটের ধোয়া থেকে শিশুদের দূরে রাখুন।
কারো সামনে সরাসরি হাঁচি দেবেন না।
পর্যাপ্ত ঘুম ও নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস করুন।
আর্থ্রাইটিস বা বাতের ব্যথা: শমরিতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডিপার্টমেন্ট অব অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহ-মুহাম্মদ শামসুল হক জানান, ‘শীতের সময় বয়স্কদের বাতের ব্যথা বেড়ে যায়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা এনকাইলোজিং স্পন্ডিওলাইটিস, স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিস, রি-অ্যাকটিভ আর্থ্রাইটিস, সোরিয়াসিটিস, অস্টিও আর্থ্রাইটিসে আক্রান্তদের সমস্যা হয় বেশি। কারণ শীতে সবাই কম নড়াচড়া করে। পর্যাপ্ত মাসল মুভমেন্ট না থাকায় ও ভিটামিন ডি’র সংস্পর্শে না আসায় বাতের ব্যথা বেড়ে যায়।
বাতের ব্যথা যেহেতু অনেকের সারাবছরই থাকে তাই লক্ষণগুলো একই ধরনের হয়ে থাকে। তবে শীতের সময় এই ব্যথা অনেককে কাবু করে ফেলে। শীতে যেন এই ব্যথায় সমস্যা না হয় সেক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো নজরে রাখা জরুরি।
প্রতিরোধ
শরীর যথাসম্ভব উষ্ণ রাখতে হবে।
হাত, পা ও কান সবসময় ঢেকে রাখা ভালো। একটানা এক জায়গায় বসে বা শুয়ে না থেকে একটু হাঁটাচলা করতে পারলে ভালো। গোসলের ক্ষেত্রে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করা ভালো।
ব্যথা বেশি হলে ফিজিওথেরাপি নেওয়া যেতে পারে। তবে প্রথমে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে দেহের অতিরিক্ত মেদ ঝরিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে হবে।
চর্মরোগ: শীতে ত্বক সবচেয়ে বেশি সংকটের মুখে পড়ে। শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. লিপি বিশ্বাস জানান, ‘শীতের শুষ্ক বাতাস ত্বক থেকে তরল পদার্থ শুষে নেয়। তখন ত্বক হয় রুক্ষ। ত্বকের ধরন-ভেদে তখন নানা সমস্যা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে শুষ্ক ত্বকের সমস্যাই হয় বেশি। ত্বক শুষ্ক হয়ে গেলে ত্বকের ঘর্মগ্রন্থি এবং তেলগ্রন্থি ত্বকের জন্য উপযোগী প্রাকৃতিক তেল উৎপাদন করতে পারে না। ফলশ্রুতিতে ত্বক অনেক শুষ্ক হয়ে যায় এবং ফাটল দেখা দেয়। পর্যাপ্ত পরিচর্যা না নিলে ত্বকে জ্বালাপোড়া ও ফাটল থেকে রক্ত ঝরার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
শুষ্ক ত্বকে নানাবিধ চর্মরোগও হয়। হাত, পা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে চুলকানি দেখা দিতে শুরু করে। পাশাপাশি চিলাইটিস, ইকথায়োসিস, একজিমা, সোরিয়াসিস, সেবোরিক ডার্মাটাইটিস, খুসকি, স্ক্যাবিস, টোপিক ডার্মাটাইটিস, ঠোঁট ফাটা, ক্র্যাক হিল বা পা ফাটা চর্মরোগসহ চুলের খুসকিও বাড়ে। এক্ষেত্রে শীতের আগমনেই প্রতিরোধমূলক প্রস্তুতি রাখতে হবে।
প্রতিরোধে যা করবেন
শীতের সময় ত্বকে অলিভ অয়েল বা নারকেল তেল ব্যবহার করতে পারেন। সঙ্গে গাজরের তেল মিশিয়ে নিলে ভালো উপকার পাবেন।
শীতে ধারাবাহিকভাবে চুল শ্যাম্পু করুন। চুলের ময়েশ্চার ধরে রাখুন।
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খান। সবুজ শাকসবজি খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিন।
খুব গরম পানি দিয়ে ত্বক ধোয়া ঠিক নয়। কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন।
শীতে চর্মরোগ ঠেকাতে ত্বকের ময়েশ্চার লক করাই আসল। পেট্রোলিয়াম জেলি, গ্লিসারিন বা অন্যান্য ঘরোয়া টোটকার মাধ্যমে সহজেই করতে পারেন।
অবস্থা খারাপ হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
কড়া আগুনের সামনে তাপ পোহাবেন না।
বেশিক্ষণ কড়া রোদেও থাকবেন না।
শীতেও সানস্ক্রিন অবশ্যই ব্যবহার করবেন।
মশাবাহিত রোগ: শীতে মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ে। ডেঙ্গু ইতোমধ্যে আমাদের জন্য ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনই প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। শীতে এই সংক্রমণের ভয় থাকে অনেক বেশি। অনেক জায়গায় মশা বেড়ে যায়। মশার প্রকোপে ফাইলেরিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো রোগের শঙ্কা থাকে। প্রতিটিই ভয়াবহ। এ বিষয়ে ইত্তেফাকের সঙ্গে আলোচনা হয় কীটতত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশারের। তিনি মশাবাহিত রোগের প্রতিরোধে যেসব পরামর্শ দিয়েছেন:
প্রতিরোধে
বাড়ির আশপাশে কোথাও মশা যেন বংশবিস্তার না করতে পারে সেদিকে গভীর নজর রাখতে হবে।
মাথাব্যথা, জ্বর, শরীর-ব্যথা করলে প্রথমে ডেঙ্গু টেস্ট করাতে হবে।
চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন অবশ্যই।
নিশ্চিত না হয়ে প্রথমেই ব্যথার ওষুধ খাবেন না। প্রথমদিকে প্যারাসিটামল খাবেন জ্বরের ক্ষেত্রে।
বাড়িতে কয়েল বা মশা-নিধনের জন্য স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক ব্যবহার না করাই ভালো।
সন্ধ্যার পর দরজা-জানালা বন্ধ রাখুন।
কয়েলের বদলে ধূপ ব্যবহার করতে পারেন।
কমন ফ্লু: সর্দি-কাশি-জ্বরকে আমরা কমন ফ্লু বলে থাকি। শীতের বৈশিষ্ট্য অনুসারেও কমন ফ্লু হয়ে থাকে। এই কমন ফ্লু সচরাচর ফুসফুসে সংক্রমণ করে শরীরের অন্যান্য অংশেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকলে অন্য কারো শরীর থেকে জীবাণু আপনার শরীরে প্রবেশ করে। তখন কমন ফ্লুতে আক্রান্ত হতে হয়। কমন ফ্লু নামটি সাধারণ হলেও এর যন্ত্রণা কমন নয়। মাথাব্যথা, জ্বর, শরীর-ব্যথা, শুষ্ক কফ ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক সাদিয়া সিরাজের অভিমত, শীতে ফ্লু নিয়েই বেশি চিন্তিত থাকা জরুরি। যে কোনো সময় তা ফুসফুসে ভয়াবহ সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
প্রতিরোধে যা করবেন
পরিচিত কেউ সর্দিতে আক্রান্ত হলে সতর্ক থাকবেন।
সবসময় সঙ্গে রুমাল বা টিস্যু রাখবেন। হাঁচি না নাক মোছার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকবেন।
শুষ্ক পরিবেশে থাকার চেষ্টা করুন। স্যাঁতস্যাঁতে ও ভেজা পরিবেশে কাজ করা ঠিক নয়।
গরম পানি দিয়ে হালকা গড়গড়া করুন।
যষ্টিমধু, লং বা ফুসফুস ভালো রাখে এমন কিছু ঔষধির ওপর নির্ভর করুন।
হাত-পা সবসময় পরিষ্কার রাখুন।
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার বেশি খান।
খাদ্য তালিকায় ভিটামিন এ ও ডি এর সংযোগ বাড়ান।
ইনফ্লুয়েঞ্জা: শীতে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় দেখা যায় ইনফ্লুয়েন্জা। ভাইরাসের সংক্রমণে এই রোগ হয়। প্রথমে সর্দি-কাশির উপসর্গ চোখে পড়বে। তাছাড়া জ্বর ও কাশিটা হয় বেশি। ক্ষেত্রবিশ্বেষে শ্বাসকষ্টও হতে পারে। ভাইরাসে আক্রান্ত দেহ দুর্বল থাকে বিধায় এই সুযোগে ব্যাকটেরিয়াও আক্রমণ করে থাকে। বিশেষ করে নাকের সর্দি যদি খুব ঘন হয় বা কাশির সঙ্গে হলুদাভ কফ আসতে থাকে, তা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণকেই নির্দেশ করে। ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে তখনই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করবেন যখন ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ধরা পড়বে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক সাদিয়া সিরাজ জানান, অনেক সময় কমন ফ্লু থেকেও ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। তা অনেক সময় অ্যাজমা রোগীদের জন্য হতে পারে প্রাণঘাতি।
প্রতিরোধে যা করবেন
উপসর্গ দেখা দিলে প্রথমে শনাক্ত করতে হবে কোন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জায় আপনি আক্রান্ত।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং শরীর উষ্ণ রাখুন।
স্যাঁতস্যাঁতে ও ভেজা পরিবেশ থেকে দূরে থাকুন।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এমন খাবার গ্রহণ করুন।