মোনাফেকি ও ভোগ-বিলাসিতায় মগ্ন আরববিশ্ব

মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৬, ২০২৪

  ।। জসিম তালুকদার ।।

তিন বীরের ইচ্ছে বাইতুল মোকাদ্দেস কে ইহুদির কবল থেকে মুক্ত করা। স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে। সুন্নী মুসলিম ছিলেন সাদ্দাম হোসেন (ইরাক), ড.মুহাম্মাদ মুরসি ইসা আল-আইয়াত (মিশর), অপরজন শিয়া মুসলিম সৈয়দ আলী হোসেইনী খামেনেয়ী (ইরান)। এবং সুন্নী মুসলিম সাদ্দম হোসেন কে মারতে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকাকে ভুমি, আকাশসীমা দিয়ে সহযোগিতা করেছে আবর বিশ্ব! ড. মুহাম্মাদ মুরসি ইসা আল-আইয়াত। মিসরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত প্রথম বৈধ প্রেসিডেন্ট। আমেরিকা- ইসরায়েলের চক্রান্তে তাঁকে অন্যায়ভাবে ক্ষমতাচ্যুত করে মিসরের কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। প্রহসনের এক বিচারিক আদালতে নিজের কথাগুলো উপস্থাপন করতে গিয়ে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

 

বর্তমানে ফিলিস্তিন বিষয়ে আরব বিশ্ব একতা নাম মাত্র। অথচ মোকাবেলায় ভীরু।

 

ইরানের সৈয়দ আলী হোসেইনী খামেনেয়ী যখন আত্মরক্ষা মূলুক সরাসরি নিজ ভুমি থেকে ইহুদী রাষ্ট্রের উপর সরাসরি আঘাত হানে তখন সৌদি আরব ও জর্দান এখন মোনাফেকিতে লিপ্ত।

 

আমরা বেশী খুশী হতাম য‌দি ইরান হামলার কারণ হিসা‌বে ফি‌লি‌স্তি‌নে ইসরা‌য়ে‌লের বর্বর হত্যা কান্ডের প্র‌তিবাদ হি‌সে‌বে এই হামলা কর‌তো।

যাই‌হোক, ইরান অন্তত হামলার মাধ্য‌মে এতটুকু বার্তা ইসরা‌য়েল‌কে দি‌তে পে‌রে‌ছে যে ইরান তা‌দের‌কে ভয় পায়না। সেইসঙ্গে ইরান তার নিজ ভু‌মি থে‌কে হামলা করে তা‌দের সামরিক সক্ষমতার জানান যেটা দি‌য়ে‌ছে সেটাও ইস‌রায়ে‌লের জন্য অবশ্যই দু‌শ্চিন্তার কারণ বটে। পেটে ভাত নাই গোপে ঘি, ইসরাইলের বর্তমান এই অবস্থা! সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও বৃটিশরা তাদের একমাত্র সহায়ক! ইরানের আক্রমণে ইসরায়েল লজ্জায় গোপন করেছে ক্ষতির হিসাবও।

 

আমাদের দেশের মুসলিমদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, আরব দেশগুলোতে খুব ভালো ইসলাম চর্চা হয়, সেখানকার মুসলিমরা আমাদের চেয়ে অনেক উৎকৃষ্ট ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে আরবদের যদি কেউ ইসলামের ধারক বা রক্ষক বলে মনে করে তবে সে বোকার স্বর্গে বাস করছে। জঙ্গিবাদসহ ইসলামের নামে যেসকল ধর্মব্যবসা আজ বিশ্বময় চলছে সেগুলোর সূতিকাগার ও পোষকদেহ এই সৌদি আরব, জর্দান, ফেরাউনের দেশ মিশর ও কুয়েত সহ তাদের প্রভাবাধীন আরববিশ্ব। আরবদেশ রসুলাল্লাহর জন্মভূমি এবং এখানেই বায়তুল্লাহ শরীফ শুধু এই সুবিধাটুকু ভাঙিয়ে তারা এই ধর্মব্যবসাগুলো চালিয়ে যাচ্ছে বর্তমান আরবদের গায়ের লেবাস, দাড়ি, টুপি, পাগড়িসহ শুধু বাহ্য বেশভূষা ছাড়া ইসলামের কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাদের জীবনে যেহেতু আল্লাহর রসুলের শিক্ষার কোনো প্রভাব নেই অথচ দেশে শরিয়ার দণ্ডবিধি চালু কাজেই এরা যতক্ষণ দেশের ভেতরে থাকে ততক্ষণ বিশেষ অপরাধ, গোনাহ করে না, কারণ শরিয়াহ আইনে অন্যায়ের শাস্তি কঠোর (অবশ্য এই চিত্র ২০/৩০ বছর আগের, বর্তমানে এদের সামগ্রিক অবস্থা ভয়াবহ)। কিন্তু একবার দেশের বাইরে যেতে পারলেই এরা পরিণত হয় দুরাচারী মানবেতর জীবে। তাকওয়া, আল্লাহভীতির কোনো প্রভাব এদের ব্যক্তি জীবনে নেই বলে এদের নিজেদের লোভ- লালসা, হিংসা, ক্ষমতার দাপট ইত্যাদির উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

 

আরবদের জাতীয় জীবনে শরীয়াহ আইন (অবশ্য তাও বিকৃত) প্রচলিত থাকলেও দ্বীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি এ সমস্ত ব্যবস্থা অন্যান্য ভাগের মতই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং প্রাক ইসলামিক যুগের মত রাজতন্ত্র, বংশতন্ত্র, গোষ্ঠিতন্ত্র ফিরিয়ে এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেহেতু তারা গোষ্ঠিতন্ত্র, বংশতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে সুতরাং স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সেখানে অচল বললে চলে, কারণ ঐসব তন্ত্রে জাতীয় সম্পদের, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের মালিক হল রাজা বাদশাহরা। আর ইসলামে সরকারি কোষাগারের মালিক হলো সমস্ত জাতি। খলিফা শুধু রক্ষক, তত্ত্বাবধানকারী ও এই জীবনব্যবস্থার নিয়মানুসারে ব্যবহারকারী।

 

অর্থাৎ , শুধু দণ্ডবিধি ছাড়া এই আরবরা অন্যান্য জাতীয় ব্যাপারে গায়রুল্লাহর অনুসারী অর্থাৎ মোশরেক। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই ভাগটি পৃথিবীর যে অংশে বাস করত তা ছিল অতি গরীব। মাটির নিচ থেকে তেল বের হওয়ার পর থেকে হঠাৎ ধন-দৌলত ও সম্পদে পৃথিবীর অন্যতম ধনী জাতিতে পরিণত হয়েছে। এখন এদের সম্পদ রাখবার জায়গা নেই। এই সম্পদ তারা কিভাবে ব্যবহার করছে? এর একটা অংশ এরা ব্যয় করছে পাশ্চাত্যের অনুকরণ করে দেশের রাস্তাঘাট, সেতু, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, বিরাট বিরাট বহুতল উঁচু দালান, হোটেল, ফ্লাইওয়ে ইত্যাদি তৈরি করে। অঢেল টাকা ব্যয় করে এগুলো এমনভাবে তৈরি করছে যে, ইউরোপের, আমেরিকার মানুষরাও দেখে আশ্চর্য হচ্ছে, হিংসা করছে। অগণিত রাজকীয় উঁচু দালান-প্রাসাদ, হোটেল, ইমারত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। শাদ্দাদ আল্লাহর সঙ্গে নাকি পাল্লা দিয়ে জান্নাত বানিয়েছিলো। সে আজ কবর থেকে উঠে এসে এদের শহর, নগর, পথ-ঘাট, হোটেল আর প্রাসাদগুলো দেখলে বলবে- আমি আর কি বানিয়েছিলাম। সম্পদের অন্যভাগ তারা ব্যয় করছে অবিশ্বাস্য বিলাসিতায়, ভূল জীবন উপভোগে, ইউরোপে, আমেরিকায়, জাপানে। দৈহিক ভোগে এরা কি পরিমাণ সম্পদ ব্যয় করে তা আমাদের মত গরীব দেশগুলোর মুসলিমরা ধারণাও করতে পারবে না, লক্ষ কোটি ডলার তাদের কাছে কিছু নয়। তাদের ঐ অঢেল সম্পদের একটা মোটা ভাগ চলে যায় সুইস ব্যাংক ঐ ইউরোপ, আমেরিকায়, জাপান, ইত্যাদি দেশের কাছে, বিলাসিতার সামগ্রীর দাম হিসাবে। পৃথিবীর সবচেয়ে দামী গাড়িগুলো কেনে এরাই। শুধু তাই নয়, রোলস, মার্সিডিস, আলফা-রোমিও, সিট্রন, ক্যাডিলাক ইত্যাদি গাড়ি শুধু কিনেই তারা খুশী নয়, এই গাড়িগুলোর বাম্পার লাইনিং ইত্যাদি তারা খাঁটি সোনা দিয়ে মুড়ে দেয়। এদের বিলাসিতার বীভৎসতার সম্বন্ধে লিখতে গেলে আলাদা বই হয়ে যাবে। এদের মধ্যে তাসাওয়াফের কিছুমাত্র প্রভাবও থাকলে এরা এমন কদর্য বিলাসিতায় নিজেদের ডুবিয়ে দিতে পারতেন না। নিজেদের অতি উৎকৃষ্ট মুসলিম বলে মনে করলেও এবং তা প্রচার করলেও আসলে ইউরোপ, আমেরিকার বাম‘তান্ত্রিকদের সাথে তাদের কার্যতঃ কোন তফাৎ নেই। এরা এই মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্র কাবা এবং বিশ্বনবী (স.) রওজা মোবারকের হেফাযতকারী হলেও এই মুসলিম উম্মাহর জন্য তাদের মনে কিছুমাত্র সহানুভূতি নেই। শিয়া- সুন্নীর অজুহাতে লিপ্ত। তার প্রমাণ হচ্ছে এই যে, নিজেদের ঘৃণ্য বিলাসিতার সামগ্রী কিনতে তাদের বিপুল সম্পদ চলে যায় ইউরোপ, আমেরিকা আর জাপানে। তারপরও যে বিরাট সম্পদ তাদের থেকে যায় তা বিনিয়োগ করেন সেই ইউরোপ, আমেরিকা, দখলদার ইসরায়েল, ভারত আর জাপানের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে, শিল্পে। টাকা জমা রাখেন ঐসব দেশের ব্যাংকেই যা থেকে লাভবান হয় ঐসব অমুসলিম দেশ ও জাতিগুলোই। ইসলাম ও মুসলিম জাতির প্রতি তাদের কিছুমাত্র ভালোবাসা যদি থাকত তবে ঐ বিরাট সম্পদ তারা অমুসলিম দেশগুলোতে বিনিয়োগ না করে গরীব মুসলিম ভৌগোলিক রাষ্ট্রগুলোতে বিনিয়োগ করতেন। এতে অন্ততঃ পার্থিব দিক দিয়ে এই হতভাগা জাতির কিছু অংশ উপকৃত হতে পারত। অন্যান্য অতি দরিদ্র মুসলিম দেশগুলোর জন্য তারা কিছু কিছু মাঝে মাঝে খয়রাত করেন যখন কোন দেশে বন্যা, ঝড় বা প্লাবনের মত প্রাকৃতিক কারণে মহাক্ষতি হয়। এইসব দেশগুলোর মানুষকে তারা ডাকেন মিসকীন বলে।

 

যে ঐক্য ছাড়া শক্তি নেই, জাতির সেই ঐক্য সুদৃঢ় রাখার জন্য রসুলাল্লাহ (স.) তাঁর জীবনের শেষ জনসমাবেশে বিদায় হজ্বে বলে গেলেন আরবের মানুষের উপর অনারব মানুষের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই যেমন নেই অ-আরব মানুষের উপর আরবের মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, অর্থাৎ সবাই সমান। মানুষে মানুষে প্রভেদের একটিমাত্র সংজ্ঞা দিয়ে গেলেন, কে কত ভাল মুসলিম। ঐ ‘উৎকৃষ্ট মুসলিমদের’ আজ মহানবীর (স.) ওসব কথা কিছুই মনে নেই। থাকলেও ওসব কথার কোন গুরুত্ব তারা দেয় না। তারা আরব, সবার শ্রেষ্ঠ এইদ অহংকারে স্ফীত হয়ে অন্যকে অনুকম্পার পাত্র মনে করছে। অবশ্য এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতিকে এড়াতে পারছেনা। ইসলাম দ্বীনে ফিতরাত, প্রাকৃতিক আইন, নিয়মের ধর্ম, সেই নিয়ম মোতাবেকই বিপুল সম্পদ ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে বলীয়ান ত্রিশ কোটি আরবের পেটের হালুয়া বের হয়ে যাচ্ছে এক কোটি ক্ষুদ্র ইসরাইলীদের লাথি খেতে খেতে। তবুও তারা অহংকারী, কারণ বাকি অনারব মুসলিমদের মত তাদেরও অপমানবোধ লোপ পেয়েছে।

 

লেখক :জসিম উদ্দীন মাহমুদ তালুকদার কলামিস্ট ও চিকিৎসক,বাঁশখালী- চট্টগ্রাম।