ডক্টর মোঃ মিজানুর রহমান
অটিস্টিক শিশুরা যে রোগে আক্রান্ত হয় তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় Autism spectrum disorder (ASD) বলে। যে কারণে এই শিশুদের অটিস্টিক বা প্রতিবন্ধী শিশু বলা হয়। এই রোগটিতে আক্রান্ত মানুষদের ব্রেইনের বিভিন্ন অংশ অন্যান্য স্বাভাবিক মানুষের ব্রেইন এর বিভিন্ন অংশের মতো কাজ করে না। মানুষের ব্রেইন এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন কাজ করার নির্দেশনা প্রদান করে মানুষের দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজ করার জন্য ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে বিশ্বে জন্মানো প্রতি ১৬০ জন শিশুর মধ্যে ১ জন শিশুর মধ্যে অটিজম রোগের উপসর্গ পাওয়া যায়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে যেখানে এই রোগ নির্ণয় অনেক সহজ লভ্য সেখানে প্রতি ৬০ জন শিশুর ১ জনের মধ্যে এই রোগের উপসর্গ পাওয়া যায়। উন্নত দেশগুলোতে অটিজম রোগ সম্বন্ধে জানার জন্য ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই রোগ সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিকদের জানার পরিধি এখন খুবই সীমাবদ্ধ যে কারণে এখন পর্যন্ত এই রোগ নিরাময়ের জন্য পূর্ণ কোন চিকিৎসা আবিষ্কার হয় নি। তবে বৈজ্ঞানিকরা এই রোগের কিছু উপসর্গ সম্বন্ধে জানতে পেরেছেন। শিশুর জন্মের পরে যত দ্রুত এই উপসর্গ গুলো নিরাময় করার চেষ্টা করা যাবে তত দ্রুত এই সমস্যাগুলো কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। শিশুর বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই সমস্যাগুলো স্থায়ী রূপ নিবে যখন সেই সমস্যাগুলো আর নিরাময় করা সম্ভাবনা অনেক কমে আসবে।
আটিজম আসলে কী?
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) অনুসারে, অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এএসডি) হলো, মস্তিষ্কের পার্থক্যের কারণে সৃষ্ট এক ধরনের অক্ষমতা। এটি মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ততাকে বোঝায়। অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা সামাজিক আচরণে ক্ষেত্রে দুর্বল ও পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাধারণত কম সক্ষম হয়ে থাকে। মানসিক সীমাবদ্ধতা ও একই কাজ বারবার করার প্রবণতা থেকে এদেরকে শনাক্ত করা যায়।
অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (এএসডি) একটি মানসিক এবং বিকাশগত অক্ষমতা যা প্রায়শই শিশুদের সামাজিক যোগাযোগ এবং আচরণে প্রভাব ফেলে। তবে, অনেকেই জানেন না যে অটিজম শিশুদের মধ্যে চোখের সমস্যাও হতে পারে, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে আরও বাধা সৃষ্টি করে। যদিও অটিজম শিশুদের সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি ও থেরাপি রয়েছে, ভিশন রেহেবিলিটেশন এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে । অটিজম শিশুদের দৃষ্টি সমস্যা সাধারণত অবহেলিত হয়। অনেক সময় এই শিশুদের চোখের সমস্যা তাদের আচরণগত ও শিক্ষাগত উন্নতিতে বাধা সৃষ্টি করে।
অটিজম শিশুদের মধ্যে ভিশন সমস্যার প্রাদুর্ভাব অনেক বেশি। সাধারণ সমস্যা গুলোর মধ্যে রয়েছে: স্ট্রাবিসমাস: চোখের বল একত্রে কাজ করতে না পারা; অ্যাম্বলিওপিয়া: চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া; কনভারজেন্স ইনসাফিসিয়েন্সি: চোখের বল একত্রে কাজ করতে অক্ষমতা।
এই সমস্যাগুলো অটিজম শিশুদের জন্য আরও জটিল হয়ে ওঠে কারণ তারা প্রায়ই তাদের সমস্যাগুলো প্রকাশ করতে সক্ষম হয় না। অটিজম শিশুদের দৃষ্টি সমস্যা সাধারণত অবহেলিত হয়। অনেক সময় এই শিশুদের চোখের সমস্যা তাদের আচরণগত ও শিক্ষাগত উন্নতিতে বাধা সৃষ্টি করে। অপ্টোমেট্রিস্টরা এ ধরনের সমস্যা চিহ্নিত করে তাদের জন্য সঠিক চিকিৎসা ও থেরাপি প্রদান করতে পারেন।
অপ্টোমেট্রিস্টরা বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক যারা চোখের স্বাস্থ্য এবং দৃষ্টি সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে দক্ষ। অটিজম শিশুদের ক্ষেত্রে, অপ্টোমেট্রিস্টরা বিশেষ দৃষ্টি থেরাপি এবং রেহেবিলটেশন প্রোগ্রাম প্রয়োগ করতে পারেন, যা শিশুদের চোখের সমস্যা মোকাবেলা করতে সহায়ক।
অনেক এএসডি শিশুদের ভিশন থেরাপির প্রয়োজন হয়। অপ্টোমেট্রিস্টরা এই থেরাপি প্রদান করে থাকেন, অটিজম শিশুদের জন্য দৃষ্টি থেরাপির প্রভাব শুধুমাত্র তাদের দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে সহায়ক নয়, বরং তাদের সামগ্রিক বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিক দৃষ্টিশক্তি শিশুদের শিখতে, খেলতে এবং সামাজিকভাবে যোগাযোগ করতে সাহায্য করে, যা তাদের মানসিক এবং সামাজিক বিকাশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (এএসডি) শিশুদের মাঝে বিভিন্ন ধরণের ভিশন সমস্যা দেখা যায়। তারা অনেক সময় চোখের মুভমেন্ট নিয়ন্ত্রণে সমস্যায় পড়ে, চোখের সংযোগ স্থাপনে অক্ষমতা এবং ফোকাস করার সমস্যার সম্মুখীন হয়। এসব সমস্যা তাদের দৈনন্দিন কাজ, শিক্ষা এবং সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
অপ্টোমেট্রিস্টদের ভূমিকা:
ভিশন এসেসমেন্ট: অপ্টোমেট্রিস্টদের প্রথম কাজ হলো এএসডি শিশুদের ভিশন এসেসমেন্ট করা। এই এসেসমেন্টের মাধ্যমে শিশুর চোখের কার্যকারিতা, ফোকাসিং ক্ষমতা, চোখের গতিবিধি এবং চোখের মাংসপেশির কাজকর্ম যাচাই করা হয়। এর মাধ্যমে দৃষ্টির কোন সমস্যা রয়েছে কিনা তা নির্ণয় করা যায়।
ভিশন থেরাপি: অনেক এএসডি শিশুদের ভিশন থেরাপির প্রয়োজন হয়। অপ্টোমেট্রিস্টরা এই থেরাপি প্রদান করে থাকেন, যা শিশুদের চোখের মাংসপেশি এবং চোখের সমন্বয় ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ভিশন থেরাপি মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি উন্নত করা সম্ভব হয়, যা শিশুর দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করে তোলে।
চশমার প্রয়োগ: প্রয়োজনে এএসডি শিশুদের চশমা ব্যবহার করতে হতে পারে। অপ্টোমেট্রিস্টরা শিশুদের দৃষ্টিশক্তি অনুযায়ী সঠিক পাওয়ারের চশমা নির্ধারণ করেন, যা তাদের দৃষ্টির সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে।
করণীয়:
নিয়মিত চেক-আপ: এএসডি শিশুদের নিয়মিত চোখের পরীক্ষা করা উচিত। এর মাধ্যমে চোখের কোন সমস্যা থাকলে তা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে এবং তা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।
ভিশন রেহেবিলিটেশন প্রোগ্রাম: বিভিন্ন ভিশন রেহেবিলিটেশন প্রোগ্রামের সাথে শিশুদের যুক্ত করা উচিত। এই প্রোগ্রামগুলো তাদের চোখের কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে এএসডি শিশুদের জন্য কার্যকর ভিশন রেহেবিলিটেশন নিশ্চিত করতে নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা উচিত:
সচেতনতা বৃদ্ধি: এএসডি এবং এর সাথে সম্পর্কিত ভিশন সমস্যার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে; প্রশিক্ষিত অপ্টোমেট্রিস্ট: ভিশন রেহেবিলিটেশনের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ অপ্টোমেট্রিস্টদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা জরুরি; প্রতিষ্ঠানিক সহায়তা: সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় ভিশন রেহেবিলিটেশন সেন্টার স্থাপন করা যেতে পারে; গবেষণা ও উন্নয়ন: এএসডি এবং ভিশন সমস্যার উপর গবেষণা বৃদ্ধি করা এবং নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করা উচিত।
বাংলাদেশে এএসডি শিশুদের ভিশন রেহেবিলিটেশন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অপ্টোমেট্রিস্টদের মাধ্যমে সঠিক ভিশন রেহেবিলিটেশন কার্যক্রম পরিচালিত হলে এই শিশুদের জীবনে বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব। তাই, এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
এএসডি শিশুদের ভিশন রেহেবিলিটেশন একটি জটিল কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অপ্টোমেট্রিস্টদের সহযোগিতায় এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এএসডি শিশুদের জীবনে দৃষ্টিশক্তির সমস্যাগুলো দূর করা সম্ভব এবং তাদের জীবনকে সহজ করা যায়।
সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এএসডি শিশুদের জন্য একটি সুন্দর ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব।
লেখক পরিচিতি: ডক্টর মোঃ মিজানুর রহমান। অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ম্যানেজমেন্ট এন্ড সাইন্স ইউনিভার্সিটি , মালয়েশিয়া।