
—সৈয়দা রাশিদা বারী
লেখক কবি ও সাংবাদিক
সম্প্রতি ঢাকাতে একটি যুদ্ধ বিমান এর পাইলট লেফটেন্যান্ট মোঃ তৌকির ইসলামের প্রশিক্ষণকালে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিমানটি পড়ে যায় উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ক্লাস চলা ঘরের ওপরে। সেটা আসলে হায়দার আলী ভবন। এ বিমান দুর্ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে সোনার মত কচি শিশুগুলো ঝলসে যায়। এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ২৪শে এপ্রিল ২০০২ সালে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নূরুন্নবী।
কোমলমতি শিশুদের রক্ষা করতে করতে মাহরিন চৌধুরী ম্যাডাম প্রায় ২০জন শিশুর জীবন বাঁচালেন। কিন্তু তিনি নিজেকে শেষ রক্ষা করতে আর পারেন নাই। ঝলসে যাওয়া শিশুদের সাথী হয়ে যান নিজেও। বার্ন ইউনিটে অনেক নিষ্পাপ শিশুর সাথে চিকিৎসাধীন অবস্থায তিনি নিজেও একই দিনে মারা গেলেন। যেন একজন অভিভাবক, একজন শিক্ষক, একজন মা, বুকের শিশুদেরকে বুকে নিয়েই মারা গেলেন। একই পথিক মাসুকা মিস, তিনিও মারা গেলেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ মাফ করো। তোমার দুনিয়ায় তোমার মানুষকে তুমি আর কতো ভাবে কষ্টের মধ্যে ফেলবা? যারা মারা গেলেন, তাদের বেহেস্তে নসীব করো। যারা বেঁচে রইলেন, তাদের সুস্থ জীবন, নেক হায়াত দান করো। আমিন।
মানুষ অর্ধেক মরে দুর্যোগে এইভাবে। মানে এই বাচ্চাদের শোকে তো আরো মানুষ মরবে। তারপরে যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্ত পাইলট। পাইলট তো একজন কিন্তু এর জন্য মারা যাবে অনেক জন। মানুষের অলক্ষে অজান্তে মারা যাবে। রয়ে রয়ে ধুকে ধুকে নানান ভাবে মারা যাবে। এটাই নিয়ম, কিন্তু মানুষ দেখে একজনকে।
একজনের জন্য আরও অনেকে মারা যায়, চিন্তা ক্রোধ, রোগে শোকে সেটা কেউ দেখেনা। দেখবে না। এটাই নিয়ম। এই যে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মৃত্য, এটাও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আওতায় আসে। ঝড়, সাইক্লোন, বন্যা, বর্ষায়ও কত বানভাসী মানুষ ভাসে। খরা রৌদ্রতাপে কত মানুষ দহন দ্রোহে মরে। আকাশের বজ্রপাত, বাতাসের বাজ, বিদ্যুৎ পড়ে মরে। এমনকি আনন্দ ভ্রমণ কালেও, ছাড়া পাইনা। গঙ্গারজলে পদ্মায় ডুবে গড়াই নদীর বানে, শুকনো গড়ায় বালির মধ্যে বালি চরে এবার মরেছে। মরে তো ফ্যামিলির একজন। একজনের প্রতিক্রিয়া কয়জনের জীবনের উপর হুমকি হয়ে দাঁড়ায়? মারা যায়? তার কি কেউ হিসাব করে মিলায়?
নদী গহ্বরে তলিয়ে বা হারিয়ে কতজন শেষ হয়। একেবারেই উধাও হয়েও যায়। মরার যে কত রকম বিচিত্র সব আনাগোনা। খবর কেউ নেয় না। কখন যে কোন দুর্যোগে কে অজান্তে কোথায় মারা যায় কে জানে? জঙ্গলের নানান পশু কর্তৃক, পশুর থাবাই অথবা কামড়ে কতজনের জীবন যায়। নানান ভাবে পৃথিবীতে মানুষ মরে। মরার পথ মোহরা কম নয়।
জাসদের এক সময়ের নেতা মরহুম নুর আলম জিকু’র একমাত্র পুত্রের মৃত্যু হয়েছে ভ্রমণের আনন্দে মুগ্ধ অবস্থায়। বন্যপ্রাণী এক হাতি নামের পাগলা হস্তির আক্রমণে। এই ফেসবুকের আমলেই তো। দুর্যোগে মানুষ মরার শেষ নাই। আর অর্ধেক মরে রাজনৈতিক মহা কু-লে আক্রান্ত হয়ে। গুম. খুন জেল জরিমানা হাজত এর পানিশমেন্ট বহু রকম এই মৃত্যুর বন্দোবস্ত। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যায়ের এবং মূর্খ অধম ধনী গরিব এমনকি জ্ঞানীগুনিও ছাড় পাই না।
খারাপ কিছু পুরুষের জন্য ধর্ষণ এবং বলৎকারের শিকার হয়েও অনেক শিশুর প্রাণ যায়। আমি তো বলেছি একজনের মরার পিছনে অনেকজনের মৃত্যু কারণ হয়। তারপর যা বাঁচে এর অর্ধেক মরে সামাজিক জিলাপির প্যাঁচে। তবে এখানে প্রাপ্ত বয়সের নারীর হার বেশি। গলায় দড়ি, বিষ খাওয়া, নদীতে ঝাঁপ দেওয়া, অনেক ধরনের। পুরুষ সংক্রান্ত জটিলতায় কত নারীর যে জীবন যাই, হদিস নাই।
পুরুষ সংক্রান্ত নানান জটিলতায় নারীদের পেটের সন্তানও ধ্বংস করা হয়। রহস্য আনন্দের মতো পুরুষ মন চাইলেই বলে দেয়, এই বাচ্চা আমার না। এই বাচ্চা আমি মানি না। বাচ্চা আরো পরে হলে মেনে নেবো। সেই বাচ্চাটা আমার হবে ইত্যাদি। মনে হচ্ছে যেন গড়ে হাজারে ১০ জন মানুষ নরমালে মরে। বাকি সব অস্বাভাবিক এবং তাদের অপ্রাপ্ত বয়সের মৃত্য।
আমার নিজের খেলার সাথীরাই তো অনেক জন নাই, তাদের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে অপ্রাপ্ত বয়সে। তাও প্রায় ১০ জন তো হবেই। বিয়ে হওয়ার পরে, বিয়ে হওয়ার আগে, তারা মারা গিয়েছে অন্যের হাতে। রিমা, সিমা, সাহিদা, নাসরিন, ফাতেমা সহ আরো অনেকে। আর তাদের মা বাবারাও মেয়েকে হারিয়ে অকাল মৃত্যুবরণ করেছেন। হাজারে ১০ জন আল্লাহর হুকুমে যাদের আজরাইল সরাসরি জান কবজ করেন। আর তো সবই অস্বাভাবিক মৃত্যুর আসামি অথবা গোলাম। কার যে কখন কোন হালে মৃত্যু হয় হচ্ছে বলা দায়।
এর আগেও বিমান প্রশিক্ষণকালে এক্সিডেন্ট করেছেন। কিন্তু এইরকম ঘটনা বিরল। যেমন ১৯৯৮ সালে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মারা গিয়েছে দুইজন। ১. পাইলট প্রশিক্ষক রফিকুল ইসলাম (২৪) ২. কো পাইলট ফারিয়া লারা (২৫)। আমার নিজের একমাত্র ফুকুর বড় পুত্র পাইলট বিমান প্রশিক্ষক ছিলেন। যিনি ভাষা সৈনিকও ছিলেন। তিনি অনেক কষ্টে প্রাণপণ চেষ্টায় সেটা সাগরে নিয়ে ফেলেছিলেন। তার ঘড়ির চেইনে এবং হাতের বিভিন্ন জায়গায় এটা লেখা ছিলো। সাগরে ফেলার ফলে বিমানে যারা ছিলেন তারাই শুধু মারা গিয়েছিলেন। আর বিমানও আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয় নাই। অন্য আর কারো কোন ক্ষতিও হয়নি। আমার কাছে এই কালেকশনটা আছে, আমার আপন চাচা বাচ্চু চাচার লেখা একটা গ্রন্থে।
১৯৫১ সাল থেকে ইউএসএ সিটিজেন শীপ ইউএসএ অবস্থানরত প্রকৌশলী বিশ্ব ভ্রমণকারী প্রবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ রফিউদ্দিন ওয়াহেদ আলী ওরফে সৈয়দ আর ডাব্লিউ আলী (বাচ্চু মিয়া), (২৪ জুন ১৯২৪ – ১৩ এপ্রিল ২০১৪ ইং চাচার লেখা একটা গ্রন্থের মধ্যে এটা আছে। এবং সাবেক প্রিন্সিপাল বাংলা কলেজ ও ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের জাহানারা হকের লেখা একটা গ্রন্থে এই তথ্য পেয়েছি।
কেননা এই পাইলট তো ছিলেন জাহানারা হকের আপন বড় ভাই। আমার ভাষা সৈনিক বাবা সৈয়দ রফিকুল ইসলাম ওরফে সৈয়দ জালাল উদ্দিন ওয়াহেদ আলী ডাকনাম পুনু মিয়া (১৯২৬-৩ জুন ২০০৮ইং)’র কাছ থেকেও শুনেছি। অন্যান্য ভাবেও জানা আছে। যেহেতু আমার তো তখন জন্ম হয়নি। আমার বাবা মায়ের বিয়েই হয়নি তখনও। ইডেনের প্রিন্সিপাল জাহানারা হকের আপন বড় ভাই ওই বিমান প্রশিক্ষক পাইলটের নাম- সৈয়দ ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ মোস্তফা দদকামাল হাই, ডাকনাম- টুলু মিয়া (১৯৩১ – ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ ইং) তখন আশ্বিন মাস ছিলো।
আমি জানি যে, আমার একমাত্র ফুপু সৈয়দা সেলিমা নুরজাহান ডাক নাম খুকু, খুকি, ফ্যালিসিয়া- (১৯০৬ – ১৩ ই মার্চ ১৯৬৩ ইং) ফুপা আগেই মারা গিয়েছিলেন। খান বাহাদুর – সৈয়দ আব্দুল হাসনাত মোহাম্মদ আব্দুল হাই (১৮৮৪ – ১৯৪৫ ইং) তিনি ছিলেন ডেপুটি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। আর ফুপু তখনকার নারী সংগঠনের সভানেত্রী এবং ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভক্ত। কাজী নজরুল ইসলামকে অর্থবৃত্তি সহযোগিতা করতেন। তখন তো আর এখনকার মত ফোন, ইমেইল, ইমো ইত্যাদি এবং বিকাশ এসব ছিল না। তাই আমি ওই সব চিঠিপত্র ও ভাউচার দেখেছি।
যাহোক, মাইলস্টোন স্কুলের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের সার্বিক কল্যাণ, আহতদের সুচিকিৎসা, প্রাণ হারিেেয়ছেন যারা তাদের সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে আল্লাহর দরবারে তাদের জন্য বেহেস্ত নসীব করার জন্য দোয়া করছি- আমিন।