১৬ বছরে ৬০ ভাগ তাঁত বন্ধ, ১৫ লাখ তাঁতী ও তাঁত শ্রমিক বেকার

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৫

 

ষ্টাফ রিপোর্টার
দিন যতো অতিবাহিত হচ্ছে বাংলাদেশের তাঁতীদের আর্থিক অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। অতীতে তাঁতীরা কটন ও পলেষ্টার সূতা, রং, রাসায়নিকদ্রব্যাদি আমদানি করে কম খরচে কাপড় উৎপাদন করতে পারতো। কিন্তু এখন সেটা বন্ধ রাখা হয়েছে। দুর্নীতির অজুহাত দেখিয়ে কটন ও পলেষ্টার সূতা, রং, রাসায়নিকদ্রব্যাদি আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। ঋণ প্রকল্প চলমান থাকলেও অনেক তাঁতী ঋণ পাচ্ছেন না। ফলে অর্থের অভোবে অনেক তাঁত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন তাঁতীরা।

বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী সরকারের জাঁতাকলে বন্ধ হয়ে যায় ৬০ ভাগ তাঁত, বেকার হয়ে পড়ে ১৫ লাখ তাঁতী ও তাঁত শ্রমিক। সরকারের পতনের পর তাঁতীরা আশায় বুক বেধেছিল। তারা মনে করেছিল এখন থেকে সকল সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার পালানোর পর থেকে বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডের ৩ কর্মকর্তা সহ ডিজিএম এর চক্রের জালে তাঁতীরা চরমভাবে হয়রানি হচ্ছে এবং তাঁতশিল্পের উন্নয়ন বাঁধাগ্রস্হ হচ্ছে। তাঁতীদেরকে ঋণ সুবিধা দেয়া হচ্ছেনা,কটন সূতা ও পলেষ্টার সূতা, রং, রাসায়নিকদ্রব্যাদি আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে, এসব কারণে তাঁতীরা চরমভাবে বিপাকে পড়েছে। সূতা রং রাসায়নিক আমদানি সুপারিশ বন্ধ থাকায় খোলা বাজারে এর দাম দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছে।
তাঁতবোর্ড থেকে তাঁতীরা কটন সূতা আমদানী সুপারিশ না পাওয়ায় খোলা বাজারে এর মূল্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও রং রাসায়নিক দ্রব্যাদির দাম বেড়েছে দ্বিগুনেরও বেশী। এর ফলে তাঁতিরা খোলা বাজার থেকে দ্বিগুণ দামে কটন সূতা রং রাসায়নিক দ্রব্যাদি ক্রয় করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু কাপড় তৈরিতে খরচ বেশি পড়ায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। ফলে অনেক তাঁতি পেশা ত্যাগ করছেন।
তাঁতীতের দাবি, বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডের অধিনে প্রাথমিক তাঁতী সমিতি রয়েছে ১৩৬০টি, জাতীয় তাঁতী সমিতির মাধ্যমে এই প্রাথমিক তাঁতী সমিতিগুলোকে প্রচলিত আংশিক শুল্কমূক্ত কটন ও পলেষ্টার সূতা, রং, রাসায়নিকদ্রব্য আমদানি করার সুযোগ সুবিধা দিতে হবে।
এছাড়া তাঁতবোর্ডের রেজিষ্ট্রেশনকৃত এই ১৩৬০টি সমিতির সকল সদস্যকে তাদের অচল তাঁতগুলো সচল করতে ও যাদের তাঁত আছে পুঁজি নাই তাদের মাঝে ঋণ বিতরন করতে হবে।
একজন বিশিষ্ট তাঁত ব্যবসায়ী সফি উদ্দিন সরকার বলেন, এখন তাঁতীদের বেগতিক অবস্হা, কাপড় উৎপাদন করলেই লোকশান গুনতে হয়। বাংলাদেশের হস্তচালিত ও বিদ্যুৎ চালিত তাঁতে শাড়ি লুঙ্গি সহ বিভিন্ন ধরনের আকর্ষনীয় কাপড় তাঁতিরা তৈরি করে থাকে। তাদের উৎপাদিত কাপড় দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সূতা,রং ও রাসায়নিকদ্রব্যের মূল্য বেড়ে দ্বিগুন হওয়ার কারণে যে কাপড়টি তৈরী করতে ৫০০ টাকা খরচ হতো সেই কাপড়টি এখন তৈরী করতে খরচ হচ্ছে ১ হাজার টাকা। আংশিক শুল্কমুক্ত কটন সূতা ও পলিষ্টার সূতা,রং ও রাসায়নিকদ্রব্য আমদানির সুবিধা পেলে কাপড় উৎপাদন ও বিক্রি করে তাঁত ব্যবসায়ে তাঁতিরা লাভবান হবে।
বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডের ডিজিএম রতন চন্দ্র সাহা এ বিষয়ে বলেন, সরকারি সুযোগ সুবিধা যখন আসে তখন রেজিষ্ট্রিকৃত তাঁতীদের মধ্যে আমরা আংশিক শুল্কমূক্ত কটন ও পলেষ্টার সূতা, রং, রাসায়নিকদ্রব্য আমদানি করার সুযোগ সুবিধা দেই। সব তাঁতীদের সুযোগ সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয়না। তবে তাঁতীরা যাতে সুযোগ সুবিধা পায় সে জন্য আমরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, আপাতত শুল্কমূক্ত কটন ও পলেষ্টার সূতা, রং, রাসায়নিকদ্রব্য আমদানি স্থগিত আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাঁতীদের মধ্যে যারা সরকারি সুযোগ সুবিধা পায় তারা অভিযোগ করে না। যারা না পায় তারা বিভিন্ন সময় সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুল্কমূক্ত কটন ও পলেষ্টার সূতা, রং, রাসায়নিকদ্রব্য আমদানি কখন করতে পারবে সেটা দিনক্ষণ ঠিক করে বলা যাবে না।
তাঁতবোর্ডের চেয়ারম্যান আবু আহমদ সিদ্দিকী টেলিফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, যারা দুস্থ তাঁতী তাদের ঋণ সুবিধা বলবৎ আছে। তাঁতবোর্ডের রেজিষ্ট্রেশনকৃত এই ১৩৬০টি সমিতির সকল সদস্যকে তাদের অচল তাঁতগুলো সচল করতে ও যাদের তাঁত আছে পুঁজি নাই তাদের মাঝে ঋণ বিতরণ প্রকল্প চলমান রেখেছে। এই সুবিধা একটি গ্রুপের মাধ্যমে দেওয়া হয়। যারা ঋণ ফেরৎ দিতে পারে না তাদের আর ঋণ দেওয়া হয় না। তারা বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে ।
শুল্কমূক্ত কটন ও পলেষ্টার সূতা, রং, রাসায়নিকদ্রব্য আমদানি সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইতোপূর্বে শুল্কমূক্ত কটন ও পলেষ্টার সূতা, রং, রাসায়নিকদ্রব্য আমদানি নিয়ে অনেক দুর্নিতি হয়েছে। বিষয়টি মন্ত্রণালয় তদন্ত করছে। ফলে এটা আপাতত বন্ধ আছে। মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দিলে আবার তাঁতীদের এই সুবিধা দেওয়া হবে।
জাতীয় তাঁতী সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব আব্দুস ছামাদ খানের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তাঁত শিল্পের উন্নয়নে বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডের মাধ্যমে তাঁতীদের মাঝে পর্যাপ্ত ঋণ সুবিধা বিতরণ ও আংশিক সূল্কমূক্ত কটন সূতা ও পলেষ্টার সূতা, রং, রাসায়নিকদ্রব্যাদি আমদানীর সুযোগ দেয়া হলে তাঁতশিল্পের উন্নতি ও প্রসার ঘটবে এবং সেখানে ব্যাপক কর্মসংস্হান সৃষ্টি হবে। তিনি আরও বলেন, তাঁতশিল্পকে ধংশের হাত থেকে বাঁচাতে এবং বাজার নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য কটন সূতাসহ পলেষ্টার সুতা, রং ও রাসায়নিকদ্রব্য (আংশিক শুল্কমুক্ত) আমদানি সুপারিশ এখন জরুরী হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, তাঁতিদের আমদানী সুপারিশে কটন সূতা কেন দেয়া হচ্ছেনা,এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে ও বোর্ড মিটিংয়ে কথা বলবো।
শুল্কমূক্ত কটন ও পলেষ্টার সূতা, রং, রাসায়নিকদ্রব্য আমদানি বন্ধ রয়েছে বলে তাঁতবোর্ডের চেয়ারম্যান আবু আহমদ সিদ্দিকী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সঠিক নয় বলে কয়েকজন তাঁতী জানিয়েছেন। তারা জানান, বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডের ডিজিএম চেয়াম্যানকে মিসগাইড করছে। চেয়ারম্যানকে প্রকৃত তথ্য জানানো হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাতীয় তাঁতী সমিতি গত ৮ জুলাই ২০২৫ তারিখে তাঁতীদের সূল্কমূক্ত কটন সূতা ও পলেষ্টার সূতা, রং, রাসায়নিকদ্রব্যাদি আমদানীর সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি লেখেন। ঐ চিঠির উত্তরে গত ১৬ জুলাই ২০২৫ তারিখে বস্ত্র মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডকে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেন। এই চিঠির কোথাও আমদানি অনুমতি স্থগিতের কোন নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চলমান নিয়মানুযায়ীই তাঁতীদের সূতা রং রাসায়নিক আমদানী সুপারিশ প্রদান এবং তা বন্টনের ক্ষেএে শুধুমাএ মনিটরিং কমিটি করে দিলে কেউ দুর্নীতি করতে পারবেনা বলে অভিঞ্জমহল মনে করেন।তাদের মতে, মনিটরিং কমিটির সদস্য থাকবে বস্ত্রমন্ত্রনালয়,জাতীয় তাঁতী সমিতি ও তাঁতবোর্ডের কর্মকর্তাগণ।