উপদেষ্টা আসিফের কুমিল্লাপ্রীতি, নিলেন ২৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৫


মো: মোহন আলী ।।

‎স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার জেলা কুমিল্লার সড়ক ও অন্যান্য গ্রামীণ অবকাঠামো মেরামত ও উন্নয়নে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিচ্ছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।



‎এ প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে আসিফ মাহমুদের নিজ উপজেলা মুরাদনগরে (৪৫৩ কোটি টাকা)। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহর উপজেলা দেবীদ্বারে (৩৩৮ কোটি টাকা)।

‎একই পথে হেঁটেছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আবদুর রশীদও। তাঁর জেলা সাতক্ষীরায় এলজিইডি নিচ্ছে ২ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প। এ প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেই ভূমিকা রেখেছেন শেখ আবদুর রশীদ। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানিয়েছে, কোনো জেলার জন্য এককভাবে এত বড় প্রকল্প এলজিইডি অতীতে নেয়নি।

‎কুমিল্লা ও সাতক্ষীরার জন্য বিশেষ প্রকল্প নেওয়া হলেও এই দুই জেলার চেয়েও খারাপ রাস্তাঘাট রয়েছে বিভিন্ন জেলায়। যেমন এলজিইডির হিসাবে, কুড়িগ্রাম জেলার ৭০ শতাংশ উপজেলা সড়কই খারাপ (পুওর ও ব্যাড)। এ জেলার জন্য কোনো একক প্রকল্প নেই। এলজিইডির কুড়িগ্রাম জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী ইউনুছ হোসেন বিশ্বাস গত ২৮ জুলাই প্রথম আলোকে বলেন, বিগত অর্থবছরে রাস্তাঘাট মেরামতে তাঁদের চাহিদা ছিল ৮০ কোটি টাকা। পেয়েছিলেন ৪০ কোটি টাকা। তিনি আরও বলেন, মানুষ রাস্তাঘাট মেরামতের দাবি নিয়ে আসেন; কিন্তু তাঁরা টাকার অভাবে মেরামত করতে পারেন না।

‎জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ অন্তর্বর্তী সরকারে প্রথমে শ্রম ও ক্রীড়া উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান। স্থানীয় সরকারের দায়িত্বে ছিলেন উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। তিন মাসের মাথায় হাসান আরিফকে সরিয়ে স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব দেওয়া হয় আসিফ মাহমুদকে। তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (ফেব্রুয়ারিতে হবে বলে ঘোষিত) আগে পদত্যাগ করবেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। আসিফ মাহমুদ নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে আলোচনা আছে।

‎কুমিল্লায় নিজের মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থার মাধ্যমে বড় প্রকল্প নেওয়ার বিষয়ে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ই-মেইল করে, খুদে বার্তা পাঠিয়ে এবং তাঁর দপ্তরে গিয়ে বক্তব্য জানার চেষ্টা করা হয়েছে।

‎অবশ্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আবদুর রশীদ বক্তব্য জানিয়েছেন। তাঁর বাড়ি সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে। তিনি বলেন, সাতক্ষীরায় বিগত ৫২ বছরে বড় কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এই জেলার প্রতি বিগত সরকারের নেতিবাচক মনোভাব ছিল। এ জেলার মানুষ নিগ্রহের শিকার হয়েছে। তিনি বলেন, রাস্তাঘাটে যাতায়াতে মানুষ কষ্ট পায়। সে জন্য এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে প্রকল্পের ব্যয় যে এত বেশি, তিনি জানতেন না।

‎অবশ্য এলজিইডির হিসাবে সাতক্ষীরার চেয়েও বেশি খারাপ রাস্তা হলো নোয়াখালী, চুয়াডাঙ্গা ও কুড়িগ্রামে।

‎কুমিল্লার জন্য শুরুতে ২ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। সাতক্ষীরায় জন্য নেওয়া হয় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প। পরে ব্যয় কমানো হয়েছে (সংশোধিত ব্যয় কুমিল্লায় ২ হাজার ৪০০ এবং সাতক্ষীরায় ২ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা)। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানিয়েছে, কুমিল্লার প্রকল্পটির ব্যয় কমিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আবার পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। সেটি এখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। একনেকে অনুমোদনের পর প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়। অন্যদিকে সাতক্ষীরার প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশন ফেরত পাঠানোর পর মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।

‎বিগত সরকারের আমলেও অগ্রাধিকারে ছিল কুমিল্লা

‎এলজিইডির নেওয়া প্রকল্পের নাম ‘কুমিল্লা জেলার গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন’। এটি ২০২৫ থেকে ২০৩০ মেয়াদে বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।

‎ডিপিপি অনুযায়ী, প্রকল্পের আওতায় সড়ক প্রশস্ত ও পুনর্বাসন, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ, ‘ইউনিব্লক’ দিয়ে গ্রামের রাস্তা উন্নয়ন, গ্রোথ সেন্টার বা গ্রামীণ বাজার উন্নয়ন ইত্যাদি কাজ করা হবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলছে, এসব কাজ শেষ হলে গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কৃষি ও কৃষি অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।

‎জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে বেশি বরাদ্দ পেত কুমিল্লা। সর্বশেষ পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে তিন অর্থবছরেই এলজিইডির রাস্তাঘাট রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দের তালিকায় শীর্ষে ছিল জেলাটি। দুই অর্থবছরে ছিল তৃতীয়।

‎বিগত সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের বাড়ি কুমিল্লায় (নির্বাচনী আসন কুমিল্লা-৯: লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ)। পাশাপাশি সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বাড়িও কুমিল্লা (নির্বাচনী আসন কুমিল্লা-১০: সদর দক্ষিণ, লালমাই এবং নাঙ্গলকোট)। তাঁরা প্রভাব বিস্তার করে বেশি অর্থ বরাদ্দ নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

‎স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বিগত সরকারের সময় অগ্রাধিকার পাওয়া কুমিল্লায় এবার নিয়মিত বরাদ্দের বাইরে আলাদা প্রকল্প নেওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।

‎‎

‎কুমিল্লা এলজিইডির তথ্য অনুযায়ী, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের উপজেলা মুরাদনগরে প্রায় ১০৭ কিলোমিটার রাস্তা মেরামত প্রয়োজন। তবে উপজেলাটি খারাপ রাস্তার দিক দিয়ে ১ নম্বরে নেই, অবস্থান ৫। যদিও এই উপজেলা সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাচ্ছে (৪৫৩ কোটি টাকা)। আর দৈর্ঘ্যের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি রাস্তা মেরামত প্রয়োজন দেবীদ্বারে (বরাদ্দ ৩৩৮ কোটি টাকা)। এরপর রয়েছে ব্রাহ্মণপাড়া (বরাদ্দ ১৩৫ কোটি টাকা), বরুড়া (বরাদ্দ ২২৬ কোটি টাকা) ও বুড়িচং (বরাদ্দ ১৬৮ কোটি টাকা)। আর উপজেলার মোট রাস্তার তুলনায় শতাংশের দিক দিয়ে বেশি মেরামত প্রয়োজন ব্রাহ্মণপাড়ায়—৭৮ শতাংশ।

‎সরকারের জাতীয় সড়ক ব্যবস্থার শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, দেশের সব উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়কের দায়িত্ব এলজিইডির। সংস্থাটির আওতাধীন গ্রামীণ সড়কের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও তাদের। এটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থা।


‎বিএনপি নেতাদের অভিযোগ ও জবাব
‎মুরাদনগরে ভালো রাস্তা যেমন আছে, তেমনি খারাপ রাস্তাও আছে। যেমন উপজেলা সদরের ভুননঘর এলাকার সড়কটি ভাঙাচোরা।

‎যদিও বিএনপির স্থানীয় নেতারা অভিযোগ করছেন, সরকারের টাকায় উন্নয়নকাজ করে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ নিজের নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন।

‎মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, উপদেষ্টা বরাদ্দ দিচ্ছেন সরকারের টাকা আর এলাকায় প্রচার করছেন নিজের নামে। বিভিন্ন রাস্তাঘাট বা স্থাপনা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপদেষ্টার চাচাতো ভাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের (কেন্দ্রীয় কমিটির বাইরে অন্য কমিটির কার্যক্রম স্থগিত) মুরাদনগর উপজেলার আহ্বায়ক উবায়দুল সিদ্দিকীকে রাখা হচ্ছে। উবায়দুল এলাকাবাসীর উদ্দেশে বলছেন, ‘উপদেষ্টা আপনাদের উপহার দিয়েছে। আপনারা আগামী দিনে উপদেষ্টার দিকে খেয়াল রাখবেন।’

‎বিষয়টি নিয়ে উবায়দুল সিদ্দিকী বলেন, বিগত সময়ে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ ছিল। বর্তমানে উপদেষ্টাদের জন্য যদি বিশেষ কোনো বরাদ্দ থাকে, তাহলে সেটি নিজের উপজেলায় দিলে অসুবিধা কেন তাঁদের। তিনি বলেন, ‘যদিও আমরা কোথাও বলিনি আসিফ মাহমুদ ব্যক্তিগতভাবে এই উন্নয়ন করে দিয়েছেন, আমরা সব জায়গায় বলছি বর্তমান সরকারের উন্নয়ন।’

‎এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের দ্বারা গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার সুষম বণ্টনের কথা বলছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জুলাই পদযাত্রার পর তা নিয়ে ফেসবুকে এক পোস্টে (২৬ জুলাই) এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার সুষম বণ্টন করতে হবে।

‎ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের জেলার জন্য এভাবে প্রকল্প নেওয়া স্পষ্টতই স্বার্থের সংঘাত এবং ক্ষমতার অপব্যবহার। বর্তমান স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা গত বছর জুলাইয়ে যখন বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন, তখন তিনি কি কর্তৃত্ববাদের পতন চেয়েছিলেন, নাকি কর্তৃত্ববাদের চর্চারও অবসান চেয়েছিলেন, এখন তাঁকে এই প্রশ্ন করা উচিত।

‎ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদী সরকারের সময় আমরা এ ধরনের প্রবণতা দেখেছি। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা দৃষ্টান্ত আশা করি। এ দুই প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেওয়া উচিত হবে না।’