কোম্পানির প্রভাবে তামাকের চাষ বৃদ্ধিতে বিডা এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ

শুক্রবার, অক্টোবর ১০, ২০২৫

জাতির সংবাদ ডটকম।।

সারাদেশে তামাক কোম্পানির আগ্রাসী প্ররোচনায় তামাক চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় একদিকে কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিরব ভূমিকা সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আজ ০৯ অক্টোবর ২০২৫, জাতীয় তামাকমুক্ত দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সভায় আলাচকগণ এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর কৈবর্ত সভাকক্ষে বিকাল ০৩টায় অনুষ্ঠিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী এবং প্রত্যাশা মাদক বিরোধী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন আহমেদ। বক্তারা সভায় তামাক চাষ বন্ধে নীতিমালা চুড়ান্ত করার পাশাপাশি “জাতীয় তামাকমুক্ত দিবস”কে সরকারি স্বীকৃতির আহ্বান জানান। এবছর জাতীয় তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে “কৃষি জমিতে তামাক চাষ, খাদ্য নিরাপত্তায় সর্বনাশ”। এতে অবিলম্বে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা চূড়ান্ত করা দাবি জানানো হয়।
ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট্রের কর্মসূচি প্রধান সৈয়দা অনন্যা রহমানের সঞ্চালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন নীতি বিশ্লেষক ও আইনজীবি এড. সৈয়দ মাহবুবুল আলম, ভাইটাল স্ট্র্যাটিজিসের কারিগরি পরামর্শক আমিনুল ইসলাম সুজন, এইড ফাউন্ডেশনের তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প পরিচালক শাগুফতা সুলতানা, ডাস্ এর টিম লিড আমিনুল ইসলাম বকুল, । সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রকল্প কর্মকর্তা মিঠুন বৈদ্য।
প্রবন্ধ উপস্থাপনায় মিঠুন বৈদ্য বলেন, তামাক চাষ ও তামাক সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে সরকার দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং, তামাক পাতার রপ্তানি শুল্ক মওকুফ করে তামাক চাষকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে তামাক চাষ বাড়ছে যা জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার উদ্বেগ তৈরি করছে। ধান, চাল ও গমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ফসলের ন্যায্য মূল্য কৃষক না পেলেও নির্ধারিত মূল্যে তামাক পাতা বিক্রয়ে সরকারের পক্ষ থেকেই কমিটি গঠন করা হয়। যা পরোক্ষভাবে চাষীদেরকে তামাক চাষে উৎসাহিত করছে।
এড. সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, সরকারের উচিত খাদ্য নিরাপত্তাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া। খাদ্যের প্রয়োজন মেটাতে এখনও আমরা বাইরের দেশের উপর নির্ভরশীল। অথচ তামাক চাষের মাধ্যমে আমরা কৃষি জমির উর্বরতা নষ্ট করছি এবং খাদ্য নিরাপত্তাকে ধ্বংস করছি। শ্রমের মূল্য ও নিরাপত্তার দিক দিয়ে বিচার করে তারা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশকে বেছে নেয়। তামাক ক্ষতিকর জেনেও দেশে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে তামাক চাষে কৃষকদের প্রলুব্ধ করে। তামাক চাষ লাভজনক – তামাক কোম্পানি এই মিথ প্রচার করে, অথচ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে কুষ্টিয়ায়, রংপুর, লালমনিরহাট,বান্দরবানসহ তামাক চাষের শীর্ষ ১০টিই জেলাই রয়েছে দরিদ্রতম জেলার তালিকায়। ২০১৭ সালের আপীল বিভাগের এক রায়েও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক চাষের জমি কমিয়ে আনাসহ নতুন করে কোনো তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিকে অনুমতি দেয়া যাবে না বলা হয়েছে।
হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রতিবছর ঘরবাড়ি নির্মাণসহ অকৃষিখাতে এক শতাংশ হারে আবাদি জমি কমছে। এই বাস্তবতায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশকে তামাকের ক্ষতি থেকে রক্ষা করা জরুরি। এক্ষেত্রে তামাকের বিকল্প চাষে কৃষকদের উৎসাহ প্রদান, কারিগরি সহায়তা, উন্নত ও দ্রুত বর্ধনশীল বীজ সার প্রদান, জামানতবিহীন স্বল্প সেবামূল্যে ঋণ প্রদানে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা সংযুক্ত করার আহ্বান জানান। আমিনুল ইসলাম বকুল বলেন, বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির সকল পণ্য নিষিদ্ধের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে প্রদান করা হয়েছে। অথচ বিদেশি সিগারেট কোম্পানিগুলো বিডাকে ব্যবহার করে দেশে সিগারেট বাজার বৃদ্ধির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে নতুন সিগারেট কোম্পানির প্রসার বা স্থাপনের যেকোনো উদ্যোগ সংবিধানে উল্লেখিত নির্দেশনা এবং আপীল বিভাগের রায়ের পরিপন্থী।
শাগুফতা সুলতানা বলেন, তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপের কারণে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা এখনও আলোর মুখ দেখেনি। কিছু সুবিধাভোগী সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা জনস্বার্থের চেয়ে কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে তৎপর। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫, এর ধারা ১২ অনুসারে তামাক জাতীয় ফসল চাষে নিরুৎসাহিত করতে সরকার প্রয়োজনীয় নীতিমালা গ্রহণের অধিকার রাখে। আমিনুল ইসলাম সুজন বলেন, ১৯৯৯ সালের ৯ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ২০১১ সাল থেকে ৯ অক্টোবর জাতীয় তামাকমুক্ত দিবস হিসাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। সরকারিভাবে এ দিবস উদযাপন করা হলে তামাকের ক্ষতিকর বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে।
সভায় সংবিধান ও আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তামাক চাষ ধীরে ধীরে বন্ধ করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এমতাবস্থায়, দ্রুত সরকার কর্তৃক প্রণীত “তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা (খসড়া)” চূড়ান্ত ও বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা, বিকল্প ফসল চাষে কৃষকদের কারিগরি সহায়তা প্রদান, উন্নত বীজ, সার ও স্বল্পসুদে ঋণ প্রদান নিশ্চিত করাসহ তামাক চাষের জমিতে দ্বিগুণ হারে ভূমি কর আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি সংরক্ষিত বনভূমি ও সরকারি খাসজমিতে তামাক চাষ বন্ধে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ, তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করা এবং তামাক পাতার উপর মওকুফকৃত ২৫% রপ্তানি শুল্ক পুনর্বহাল করার দাবী জানান।

সভায় জাতীয় যক্ষা নিরোধ সমিতি (নাটাব), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস), ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’র টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল, গ্রাম বাংলা উন্নয়ন কমিটি, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট, রানি, কেএইচআরডিএস (কেরানীগঞ্জ), কসমস (নাটোর), নবনীতা মহিলা কল্যাণ সমিতি (রামপুরা) শিশুদের মুক্ত বায়ু সেবন সংস্থা, শীল্ড, আইডাব্লিউবি, ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট স্কুল, গ্রীন ফোর্স স্বেচ্ছসেবী সংস্থার প্রভৃতি সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।