বন্দর চুক্তি নিয়ে গোপনীয়তা কেন ?

বুধবার, নভেম্বর ২৬, ২০২৫

 

               ।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।
দেশের বন্দরগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির রক্তপ্রবাহ হিসেবে পরিচিত। গত কয়েক দশকে অর্থনীতির যে উত্থান ও প্রসার, তার নেপথ্যে বড় ভূমিকা রাখছে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বন্দর। রাজস্ব আয়, পণ্যের অবাধ চলাচল আর সহনীয় ফি ও মাশুলের কারণে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের কাছে বন্দরের গুরুত্ব বাড়লেও এখন এমনভাবে তা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে যে, সামনে বন্দরই হতে পারে অর্থনীতির গলার কাটা। গোপন চুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ কয়েকটি বন্দরের সাতটির মধ্যে পাঁচটি টার্মিনালই তুলে দেওয়া হয়েছে বিদেশিদের হাতে। অন্তর্বর্তী সরকারের চট্টগ্রাম ও ঢাকার দুই বন্দর পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানির সাথে সম্পাদিত চুক্তি নিয়ে গোপনীয়তা করছে কেন সরকার ? নিজেদের ঘোষণা অনুযায়ী, অন্তর্র্বর্তী সরকার আগামী দুই-তিন মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকার কথা নয়। তাহলে এ রকম একটা সরকার কী কারণে ৪০-৫০ বছরের এমন একটা চুক্তি সম্পাদন করবে, যেটা পুরো অর্থনীতি ও দেশকে প্রভাবিত করতে পারে এবং যার মধ্যে অনেক ধরনের উদ্বেগের বিষয় থাকতে পারে। সেই চুক্তি স্বাক্ষর কেন গোপনীয়তা ও অস্বচ্ছতার সঙ্গে ছুটির দিনে তাড়াহুড়া করে করা হবে? তারা এ ধরনের একটা চুক্তি করার এখতিয়ার কী বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালিন সরকারের আছে ?

গত ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালটি ৩০ বছরের জন্য পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে ডেনমার্কভিত্তিক শিপিং ও লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠান এপি মোলার মায়ের্স্ক (এপিএম)। এছাড়া, একইদিনে বুড়িগঙ্গার পাড়ে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালকে ২২ বছরের জন্য সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেডলগের দায়িত্বে দিতে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল। এখানকার ৪৪ শতাংশ কন্টেইনার সামলায় এনসিটি। এই টার্মিনালে একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ ও একটি অভ্যন্তরীণ নৌপথের ছোট জাহাজ ভেড়ানো যায়। এনসিটিতে জাহাজ থেকে বার্ষিক ১০ লাখ একক কনটেইনার ওঠানো-নামানোর স্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে। গত বছর এই টার্মিনাল ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডেল করেছে।

এনসিটি পরিচালনা করতে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিদেশি কোম্পানির চুক্তি-সম্পর্কিত প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে শুনানি চলছে। নিষ্পত্তি হলে সরকার টার্মিনালটি সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডকে পরিচালনা করতে দিয়ে দেবে। তার আগ পর্যন্ত বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি-সম্পর্কিত প্রক্রিয়া চালানো যাবে না বলে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তির বিপক্ষে দেশের স্বার্থ রক্ষাসহ কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং প্রক্রিয়াগত নানা উদ্বেগ দেখিয়ে জোর সমালোচনা চলছে নানা পক্ষ থেকে। গত ১৭ নভেম্বর সম্পাদিত চুক্তিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমস কী পরিমাণ ট্যারিফ, মাশুল, চার্জ, শুল্ক-কর ইত্যাদি পাবে, সেই বিষয়গুলো গোপন রাখা হয়েছে। এ চুক্তি নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষিতে সরকার বলছে, লালদিয়া এবং পানগাঁও বন্দর পরিচালনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হওয়া চুক্তিটি নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (গোপন চুক্তি)। তাই এ নিয়ে খুব বেশি তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না।

চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল নিয়ে চুক্তির বিস্তারিত দেশবাসীর সামনে প্রকাশ করা উচিত। লালদিয়া ও পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনালের চুক্তিপ্রক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত গ্রহন ত্রুটিপূর্ণ ও অস্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় বন্দর ব্যবহারকারীদের যুক্ত করা হয়নি; তারা চুক্তির শর্ত ও বিষয় সম্পর্কে জানেন না। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালের ক্ষেত্রেও একই ধরনের তাড়াহুড়া ও অস্বচ্ছতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রকল্পে সময় নিয়ে অংশীজনদের মতামত গ্রহণ না করলে প্রকল্পের ব্যয় ও কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একইভাবে লালদিয়া, পানগাঁও ও নিউমুরিং টার্মিনালের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি দেশের জাতীয় স্বার্থের জন্য হুমকির সম্ভাবনা রয়েছে। অতীত সরকারের সময় এ রকম উদ্যোগে কমিশনভোগীদের যে গোপন সংশ্লিষ্টতা থাকত, তা থেকে বাংলাদেশ মুক্তি চেয়েছিল বিগত গণ-অভ্যুত্থানে।

দেশবাসী চায় না, অতীতের মতো এ রকম গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ নিয়ে গোপনে কোনো চুক্তি হোক। চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন টার্মিনাল নিয়ে সিদ্ধান্ত হতে হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে। বন্দরের মতো কৌশলগত সম্পদ নিয়ে চুক্তি করার আগে চুক্তির শর্ত দেশবাসীর নিকট প্রকাশ করতে হবে। তাই ১৭ নভেম্বর সম্পাদিত চুক্তি অবিলম্বে প্রকাশ করতে হবে। যেখানে সরকারের অস্থিরতা থাকা উচিত ছিল আইনশৃঙ্খলা, নারী নির্যাতন, মব সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়ে, কিন্তু বন্দর ইজারা নিয়ে অস্বাভাবিক তৎপরতা জনস্বার্থবিরোধী বলেই দেশবাসী মনে করে। মনে রাখতে হবে, বিদেশি বিনিয়োগ মানেই উন্নয়ন, এই ধারণা বিভ্রান্তিকর। দেশের ৯০ শতাংশ আমদানি-রফতানি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হয়, সেখানে বিদেশি কর্তৃত্ব কৌশলগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার অসমাপ্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দেশকে একটা ভয়াবহ বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়ার সকল দায় বর্তমান সরকারকেই বহন করতে হবে।

অস্বচ্ছ ও গোপন চুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর কার্যত বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার দেশীয় স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহন করছে কি বর্তমান সরকার ? চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। আবার দেশের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুও চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই চট্টগ্রাম বন্দরের বিষয়ে তাড়াহুড়ো করে অস্বচ্ছ ও গোপন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান সরকার তাই করতে চাচ্ছে। কোনো দরপত্র ছাড়াই পতিত স্বৈরাচারের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক বিদেশি কোম্পানিকে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) তুলে দেওয়ার যাবতীয় ষড়যন্ত্র চলমান রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া ভবিষ্যতে ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অস্বাভাবিক দ্রুততায় বিদেশি কোম্পানির কাছে কনটেইনার টার্মিনাল তুলে দেওয়া দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশের বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ায় দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। এটি জাতীয় স্বার্থেরও পরিপন্থী।

বিদেশিদের হাতে টার্মিনাল ও বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার সঙ্গে জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার প্রশ্ন যুক্ত আছে। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহনের ভিত্তি নাই। বিগত স্বৈরাচারী সরকার দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশকে একটি তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এমন কর্মকাণ্ড অতীতকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। দেশের জনগণ, জনমত ও জন–আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে যেকোনো কার্যক্রম জনরোষের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর করবে। বন্দর উন্নয়নের নামে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে করা গোপন এই চুক্তি আসলে জাতীয় সম্পদ বিক্রির সমতুল্য। বন্দর ইতোমধ্যেই লাভজনক ও বিশ্বমানের। অথচ বিদেশি কোম্পানির লুটপাটের অংশ হিসাবে শুল্ক ৪১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়াবে। অন্তর্বর্তী সরকার সম্পূর্ণ এখতিয়ার বহির্ভতভাবে লাভজনক টার্মিনালগুলোর নিয়ন্ত্রণ বিদেশি কোম্পানিকে দিতে চায়, যা দেশের জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী।

বাংলাদেশের অন্তত পাঁচটি টার্মিনালে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দেওয়ার আলোচনায় জোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে বেশ কয়েকটি সংগঠন। এর মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ), গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি, কয়েকটি বাম রাজনৈতিক দল, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, বাংলাদেশ ন্যাপ, হেফাজতে ইসলাম। তাদের প্রশ্ন, নির্বাচনের ঠিক আগে তাড়াহুড়ো করে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘমেয়াদে এতবড় কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রাখে কিনা? বাংলাদেশের জনগণের জানার অধিকার আছে—এতে দেশের স্বার্থ ও লাভ কতটা থাকবে, জাতীয় নিরাপত্তায় কোনো ঝুঁকি তৈরি হতে পারে কিনা? চট্টগ্রামের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) দেশীয় প্রতিষ্ঠান ১৭ বছর ধরে সফল ও লাভজনকভাবে পরিচালনা করছে। এটি তার নির্ধারিত সক্ষমতার চেয়ে বেশি কনটেইনার হ্যান্ডল করছে এবং এক হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করছে। প্রশ্ন উঠেছে, এমন একটি লাভজনক টার্মিনাল বিদেশি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে কেন?

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আমাদের দেশের জচনগন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বশ্যতা অস্বীকার করেছিল। কিন্তু অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারও বিদেশি কোম্পানিকে দেশের সমুদ্রবন্দর ইজারা দেওয়ার দেশের স্বার্থ বিরোধী চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের চেতনা সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করছে। গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিকেরা যখন বকেয়া মজুরির দাবিতে আন্দোলন করেছে, আন্দোলন দমনে সরকার পুলিশ বাহিনী দিয়ে শ্রমিক হত্যা করেছে। সরকার ভুলে গেছে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শ্রমজীবী মানুষের জীবনের অবদান সবচেয়ে বেশি। সবাইকে মনে রাখতে হবে, সরকারের বন্দর চুক্তি ‘জনগণের সঙ্গে প্রতারণা’। বন্দর দেশের অর্থনীতি, সার্বভৌমত্ব এবং ২৪ জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের আদর্শের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।

চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন কনটেইনার টার্মিনাল এবং পানগাঁও নৌ টার্মিনালকে বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই তাড়াহুড়ো চুক্তি গণ-অভ্যুত্থানের আদর্শের পরিপন্থী, কারণ জনগণের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা বিদেশি শক্তির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। এটি বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া মানে জাতীয় সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানো। আফ্রিকার জিবুতির মতো দেশে অনুরূপ চুক্তির কারণে বিপুল ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে।

একটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার কোনো এখতিয়ার এ রকম অস্থায়ী সরকারের থাকে না। এসবের জন্য নির্বাচিত সরকার দরকার হয়। শুধু নির্বাচিত সরকারও এভাবে করতে পারে না। নির্বাচিত সরকার এ ধরনের চুক্তি করলে সেগুলো সংসদে তুলতে হবে, সেখানে তর্ক-বিতর্ক হবে, দেশের মানুষ জানবে। আর কয় মাস পর নির্বাচন। এই সময় সরকারের এই ধরনের চুক্তিতে এত আগ্রহ কেন? বন্দর নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি যদি দেশের উন্নয়নের জন্যই হয়, তাহলে এত গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা ও তাড়াহুড়া কেন?

(লেখক : রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক )
E-mail : gmbhuiyan@gmail.com