৮ ডিসেম্বর ‘৭১ ছাতক মুক্ত হয়ঃ সেনারা আসে ২৮ এপ্রিল

মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ২, ২০২৫

শহীদ আহমদ খান।।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শিল্প শহর ছাতক একাত্তরের ৮ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত হয়। তবে এজন্যে কোন যুদ্ধের প্রয়োজন হয় না। অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসছে খবর পেয়েই পশ্চিমারা পলায়ন করে। খান সেনারা ছাতক থানা সদরে পৌঁছে সিলেট থেকে সড়ক পথে হেঁটে। সেদিন ছিল ২৮শে এপ্রিল। আর সময়টা ছিল দুপুর বেলা। এর আগে সকাল ৮টার দিকে পথিমধ্যে গোবিন্দগঞ্জে আটককৃত অনেকের মধ্যে বেছে বেছে হিন্দু তিনজনকে হত্যা করে জল্লাদরা। অন্যাদেরকে অবশ্য ছেড়ে দেয়। হানাদার পাকিস্তানী সেনারা ছাতকে ঢোকার পথে শহরতলীর মাধবপুরে ইপিআর (এখানকার বিডিআর) ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়; কিন্তু সেই প্রতিরোধযুদ্ধ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। তাই পশ্চিমারা শহরে ঢুকে পড়ে ঘন্টা খানের মধ্যেই। সেই সাথে মেতে উঠে পৈশাচিক উন্মত্তায়। হত্যা করে সর্বপ্রথম ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী দিলীপ তরাতকে। এরপর তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শামসু মিয়া চৌধুরীর বাবা ময়না মিয়া চৌধুরী ও ও ভ ভাই সমুজ মিয়া চৌধুরীকে ছেলে জ্যোতির্ময় দত্ত (নানু) সহ ব্যবসায়ী যোগেন্দ্র দত্তকে এবং কুমুদ রঞ্জন দাস, মুখলেছুর রহমান প্রমুখকে। পরবর্তী সময়ে বেতুরা গ্রামের ফকিব চেয়ারম্যান নামে পরিচিত মতরি আলীর হাতে ধরা পড়া ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং আরো অনেককেও প্রিয়জনদের কাছ থেকে চিরতরে কেড়ে নেয়। এসব বীর শহীদের স্মরণে ‘শিখা সতেরো’ ছাড়া কোন স্মৃতি সৌধ এখন পর্যন্ত গড়ে উঠেনি।

পালা মার্চ ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের আহুত অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত ঘোষণা করা মাত্র পূর্ব বাংলার অন্যান্য স্থানের মতো ছাতকের মানুষও বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। একটানা চলতে থাকে সভা, সমাবেশ ও মিছিল। থানা সদরের বাইরেও একই অবস্থা। তখনকার জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল হক এক পর্যায়ে আওয়ামীলীগের আচ্ছা মিয়া, ন্যাপের মঈন উদ্দিন, ফারুক আহমদ, ছাত্রলীগের চাঁন মিয়া চৌধুরী ও ছাত্র ইউনিয়নের মোঃ আব্দুল ওদুদকে নিয়ে সীমান্ত এলাকায় সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেন। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী ছাতকে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।

এতে চৌধুরী। সম্পাদক ও সহ সম্পাদক নির্বাচিত হন ন্যাপের যথাক্রমে মদরিছ আলী ও মানিক মিয়া। অন্যান্য কর্মবর্তা ও সদস্য ছিলেন আওয়ামীলীগের আব্দুল হক, শামসু মিয়া চৌধুরী, হাবিবুর রহমান, নিজাম উদ্দিন বুলি, পিয়ারা মিয়া, হারিছ মিয়া, ডাঃ খলিলুর রহমান, আতাউর রহমান, আরজ আলী, আসগর আলী, যোগেন্দ্র চন্দ্র দে, ইলিয়াস আলী, ন্যাপের আব্দুল কবির, আব্দুল খালিক, আব্দুল কুদ্দুছ চৌধুরী, আব্দুল মতিন, মঈন উদ্দিন, আজফর আলী, ছাত্রলীগের চা, মিয়া চৌধুরী, গোলাম নবী, ছাত্র ইউনিয়নের মোঃ আব্দুল ওদুদ, আব্দুস সালাম, আব্দুল গফফার ইরাজ, আমীর আলী প্রমুখ। এছাড়া, ডাঃ নেছার আহমদ এবং ইলিয়াস আলীসহ দল নিরপেক্ষ কয়েকজনও এর সাথে সংযুক্ত ছিলেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মোঃ আব্দুল ওদুদ। মহিলারাও সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং শহরে মিছিল করেছিলেন। পাক দস্যুদের পথ রোধ করতে লামাকাজি ফেরি ধ্বংস করা হয়েছিল। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল মাধবপুর সেতুর কাঠের পাটাতন। নিয়মিত টহলের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। এসব কাজে অংশ নেন সর্বস্তরের মানুষ। পশ্চিমাদের আগমণের খবর সর্বপ্রথম একজন রিক্সা চালক নেতাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

ছাতক মুক্তিযুদ্ধের ৫ নম্বর সেক্টরের মেলা সাব-সেক্টরের অন্তর্গত ছিল। সাব-সেক্টর অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন, (পরে লেঃ কর্ণেল) এ. এস হেলাল উদ্দিন। রাজনৈতিক সংগঠক ছিলেন জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল হক এবং হেমেন্দ্র কুমার দাশ পুরকায়স্থ, মরহুম ডাঃ হারিছ আলী প্রমুখ।

‘মহিলা মুক্তিফৌজ’ নামে একটি সহায়ক সংগঠনও সেখানে গড়ে তোলা হয়েছিল। বড় ধরণের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সিমেন্ট, কারখানা, টেংরা টিলা, কালিউরা, টেবলাই, কালারুকা প্রভৃতি স্থানে। সর্বশেষ মোঃ আব্দুস সামাদের অধিনায়কত্বে জিয়ন কুমার দাস মিন্টু, আব্দুল হান্নান, আব্দুল কাদির, ব্যারিষ্টার, আব্দুল হাসিব ও নুরুল আমিন সহ ১৫জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল এবং অন্যরা ৮ই ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক ৮টায় সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে বিনা বাঁধাই থানা সদরে প্রবেশ করে বিজয়ের বারতা ঘোষণা করেন। সাথে সাথে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে।