।। মো. বাবুল ইসলাম।।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু নাম কেবল ব্যক্তি নয়—তারা একটি সময়, একটি দর্শন, একটি আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি। বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন তেমনই এক নাম। আপোষহীনতা, দৃঢ়তা ও নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে যিনি কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছেন। তাঁর প্রয়াণের খবরে দেশ আজ এক গভীর শোক ও স্মৃতিচারণার মুহূর্তে দাঁড়িয়ে।
তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, তিনবারের সরকারপ্রধান, এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর দীর্ঘদিনের চেয়ারপারসন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল সংগ্রামে ভরা, দ্বন্দ্বে জর্জরিত, কিন্তু একই সঙ্গে ইতিহাস গড়া এক অধ্যায়।
আজ তাঁর অনুপস্থিতি শুধু একটি রাজনৈতিক দলের জন্য নয়—সমগ্র জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসে এক শূন্যতা তৈরি করেছে।
মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়া শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
বিএনপি মিডিয়া সেলের সদস্য আতিকুর রহমান রুমন সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন। এ ছাড়া ফেসবুকে দলটির সবগুলো পেজ থেকে বেগম জিয়ার মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছে। তার এই প্রস্থানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো।
দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন দেশের প্রথম এবং মুসলিম বিশ্বে দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী।
গত ২৩ নভেম্বর গভীর রাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে এভার কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টা আর কোটি মানুষের দোয়াকে ব্যর্থ করে তিনি চিরবিদায় নিলেন।
বেগম জিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক প্রভাবশালী অধ্যায়। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন শুধু একটি দলের নেতা নন—তিনি ছিলেন একটি সময়, একটি সংগ্রাম এবং একটি মতাদর্শের প্রতীক।
একসময়ের লাজুক গৃহবধূ সময়ের প্রয়োজনে হয়ে উঠেছিলেন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের আপোষহীন নেত্রী। স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলের হাল ধরা, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া, ১/১১-এর ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা এবং বিগত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করা- বেগম খালেদা জিয়ার জীবন এক ত্যাগের মহাকাব্য।
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জলপাইগুড়িতে (অবিভক্ত দিনাজপুর) বেগম খালেদা জিয়া জন্মগ্রহণ করেন। খালেদা খানম পুতুল ছিলেন স্বভাবত ধীরস্থির, লাজুক এবং প্রচারবিমুখ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসার জিয়াউর রহমানের সাথে বিয়ের পর তার জীবন আবর্তিত হতো স্বামী, সংসার আর সন্তানদের ঘিরে। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনের গতিপথ পাল্টে দেয়। ১৯৭১ সালে স্বামী জিয়াউর রহমান যখন ‘উই রিভোল্ট’ বলে বিদ্রোহ ঘোষণা করে রণাঙ্গনে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন দুই শিশু সন্তান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোসহ বেগম জিয়া ছিলেন ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি।
মুক্তিযুদ্ধের সেই ৯ মাস তিনি চরম অনিশ্চয়তা ও মানসিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন তিনি । খালেদা জিয়া প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে মৃত্যুর শঙ্কায়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি মুক্ত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জিয়াউর রহমান যখন সেনাপ্রধান এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখনও বেগম জিয়া নিজেকে রাজনীতির চাকচিক্য থেকে দূরে রেখেছিলেন। বেগম জিয়া ছিলেন একজন আদর্শ মা ও স্ত্রী। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও তিনি সাধারণ জীবনযাপন করতেন, যা তাকে পরবর্তীতে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যু বেগম জিয়ার জীবনের সব আলো নিভিয়ে দেয়।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অকাল প্রয়াণে এবং পাকিস্তান বাহিনীর আতঙ্কময় হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি জীবন্ত রাখার সংগ্রামেই গড়ে ওঠে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন। পুরুষশাসিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে তিনি শুধু টিকে থাকেননি—নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন শক্তিশালী নেতৃত্ব হিসেবে।
বেগম জিয়া দলের প্রবীণ নেতা ও কর্মীদের অনুরোধে ঘর ছেড়ে রাজপথে নামেন। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হন এবং ১৯৮৩ সালে দলের হাল ধরেন। রাজনীতিতে তার এই আগমন ছিল অনেকটা ধুমকেতুর মতো। স্বামী হারানোর শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে তিনি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া চষে বেড়ান। যে নারী একসময় জনসমক্ষে কথা বলতে সংকোচ বোধ করতেন, তিনিই হয়ে ওঠেন কোটি জনতার কণ্ঠস্বর।
১৯৮৪ সালে বিপ্লবী চেতনার নেতা হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন এবং জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অসীম সাহস, নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা তাঁকে এনে দেয় জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে।
১৯৮৬ সালে যখন অন্য অনেক দল এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তখন বেগম জিয়া দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, “এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। এই নির্বাচনে যাওয়া মানে স্বৈরাচারকে বৈধতা দেওয়া।” তার এই একটি সিদ্ধান্তই তাকে জনগণের কাছে ‘আপোষহীন নেত্রী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। দীর্ঘ ৯ বছর তিনি রাজপথে লড়াই করেছেন। মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল এবং বারবার গৃহবন্দিত্ব বরণ করেছেন, কিন্তু কখনোই নীতির প্রশ্নে মাথা নত করেননি। তার অনড় অবস্থানের কারণেই ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদের পতন ত্বরান্বিত হয়। তার নেতৃত্বে সাত দলীয় জোটের রূপরেখা অনুযায়ী দেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া জনগণের ভোটে নির্বাচিত বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় মসলিম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনামলে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়—যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশকে শুধু একটি রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে গড়ে তোলেনি, তিনি দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে নারীর নেতৃত্বের এক প্রতীক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
তোর শাসনআমলে শিক্ষা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেয়া হয়; প্রাথমিক শিক্ষাকে বিনামূল্যে ঘোষণা, মেয়েদের শিক্ষার সম্প্রসারণ ও বৃত্তি চালু করা হয়। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির মতো সংস্কারও হয়।
এছাড়াও তিনি টেলিযোগাযোগ খাতের একচেটিয়া ব্যবসা ভেঙে দিয়ে মোবাইল ফোন সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসেন। পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন নিষিদ্ধকরণ, সামাজিক বনায়ন এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে এলজিইডি-র মাধ্যমে রাস্তাঘাট নির্মাণের বিপ্লব তার আমলেই সাধিত হয়। ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর প্রবর্তন করে তিনি দেশের রাজস্ব আয়ে গতিশীলতা আনেন। সেই সাথে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত করার অঙ্গীকার মুখ্য ছিল তাঁর।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি হলে রাজনীতিতে নেমে আসে কালো ছায়া। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে ওঠে। সে সময় বেগম জিয়াকে দেশ ত্যাগের জন্য প্রচণ্ড চাপ দেওয়া হয়। বলা হয়েছিল, তিনি যদি সৌদি আরবে চলে যান তবে তার ছেলেদের মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু বিমানবন্দরে সব প্রস্তুত থাকার পরেও তিনি দেশ ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। সে সময় এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীর বরাতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়েটার্স লিখেছিল, “Yes, the scenario has changed and she will not go.”
তবু তিনি কখনো আপস করেননি—এই আপোষহীনতাই তাঁকে সমর্থকদের কাছে কিংবদন্তি করেছে।
এই সাহসী ও দেশপ্রেমিক অবস্থান চক্রান্তকারীদের ব্লু-প্রিন্ট নস্যাৎ করে দেয়। মিথ্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে সাব-জেলে রাখা হয়, কিন্তু তিনি দেশের মাটির প্রতি তার অঙ্গীকার থেকে একচুলও নড়েননি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দীর্ঘ ১৬ বছর বেগম খালেদা জিয়ার ওপর যে ধারাবাহিক মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন নির্মম ব্যবহার বিশ্ব রাজনীতিতেও বিরল।
বেগম খালেদা জিয়াকে নির্যাতনের প্রথম বড় আঘাতটি আসে ২০১০ সালে। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে যে বাড়িতে তিনি বসবাস করছিলেন ঢাকা সেনানিবাসের মইনুল রোডে। তার স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ঢাকা সেনানিবাসের মইনুল রোডের সেই বাড়ি থেকে বেগম জিয়াকে এক কাপড়ে আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে উচ্ছেদ করা হয়। সেদিন দেশের মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছিল- স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বাড়ি ছাড়ছেন। এই ঘটনা ছিল তার ওপর মানসিক নির্যাতনের প্রথম ধাপ, যার উদ্দেশ্য ছিল তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলা।
২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি যখন ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ কর্মসূচির ডাক দেন, তখন সরকার তার গুলশানের বাসভবনের সামনে বালু ও ইটভর্তি পাঁচটি বিশাল ট্রাক আড়াআড়িভাবে রেখে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। গেট দিয়ে বের হতে চাইলে তার ওপর সরাসরি পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করা হয়। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাথে এমন আচরণ ছিল চরম ধৃষ্টতা।
২০১৫ সালে টানা অবরোধ চলাকালীন তাকে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে টানা ৯৩ দিন অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট এবং খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই অবরুদ্ধ অবস্থায় খালেদা জিয়াকে জানানো হয় ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুসংবাদ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে নির্বাসনে থাকা অবস্থায় মালয়েশিয়ায় কোকো মারা যান। সরকার তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে এই বিয়োগান্তক ঘটনাকেও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টিরও বেশি রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলা দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্জন প্রকোষ্ঠে বন্দি রাখা হয়। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থাকার ফলে তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। আর্থ্রাইটিসের তীব্র ব্যথায় তার হাত-পা বেঁকে যেতে থাকে, ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) স্থানান্তর করা হলেও সেখানে তিনি সঠিক চিকিৎসা পাননি বলে পরিবারের অভিযোগ ছিল। চিকিৎসকরা বারবার তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দিলেও তৎকালীন সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি।
বারবার বলা হয়েছিল, “আইনি প্রক্রিয়ায় ছাড়া তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না।” করোনা মহামারীর সময় শর্তসাপেক্ষে তাকে কারাগার থেকে বাসায় থাকার অনুমতি দেওয়া হলেও তা ছিল কার্যত গৃহবন্দিত্ব। তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না, বিদেশে যেতে পারবেন না- এমন নানা শর্তে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এতকিছুর পরেও তিনি নতি স্বীকার করেননি। সরকারের কোনো অন্যায্য প্রস্তাবের সাথে তিনি আপোষ করেননি। তার এই নীরব সহ্যশক্তিই তাকে ‘মাদার অফ ডেমোক্রেসি’ বা গণতন্ত্রের মা উপাধিতে ভূষিত করেছে।
আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার কেবল মিথ্যা মামলা বা কারাবাস দিয়েই ক্ষান্ত হননি; তার বিরুদ্ধে চালিয়েছিলেন এক ভয়াবহ চরিত্র হননের অভিযান। রাজনৈতিক শিষ্টাচারের সব সীমা লঙ্ঘন করে শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষপূর্ণ, অমানবিক ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। বেগম জিয়াকে জনমনে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য ‘এতিমের টাকা চোর’ বলে বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এমনকি বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত জীবন, তার সাজগোজ এবং খাদ্যাভ্যাস নিয়েও শেখ হাসিনা সংসদে ও জনসভায় নিয়মিত কুরুচিপূর্ণ মশকরা করতেন।
তিনি যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, শেখ হাসিনা তখন প্রকাশ্যে বলেছিলেন, বেগম জিয়া অসুস্থতার ভান করছেন বা “নাটক করছেন”। এমনকি তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, “খালেদা জিয়ার বয়স হয়েছে, এখন তো অসুখবিসুখ হবেই, মরে গেলে আমরা কী করব?” কিন্তু বেগম জিয়া এসব কুরুচিপূর্ণ কথার জবাবে কখনোই পাল্টা কটু কথা বলেননি, বজায় রেখেছিলেন তার স্বভাবসুলভ আভিজাত্য ও নীরবতা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার উত্তাল বিপ্লবে যখন দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের পতন ঘটে এবং শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান, তখন বেগম খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতালের বিছানায় চিকিৎসাধীন। হাসিনার পতনের পরদিনই, ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের আদেশে তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে তার দীর্ঘ ৬ বছরের কারাবাস ও কার্যত গৃহবন্দিত্বের। যে নেত্রীকে তিলে তিলে শেষ করার জন্য ‘মাদার অফ ডেমোক্রেসি’ থেকে ‘সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি’ বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তিনি মুক্ত হলেন বীরের বেশে, আর তার নির্যাতনকারী লুকিয়ে দেশ ছাড়া হলো।
হাসিনার পলায়ন এবং আওয়ামী লীগের পতনের খবর শুনে তিনি মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন এবং কোনো বিজয়োল্লাস বা প্রতিপক্ষকে দমনের মানসিকতা দেখা যায়নি। বরং বিজয়ের পর তিনি দেখিয়েছিলেন এক অসাধারণ রাষ্ট্রনায়কোচিত উদারতা।
বেগম জিয়া ছাত্রজনতার বিপ্লবে মুক্তির পর ৭ আগস্ট নয়াপল্টনে বিএনপির ঐতিহাসিক সমাবেশে হাসপাতাল থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন এবং তিনি যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
দীর্ঘদিনের নির্যাতন ও অবিচারের শিকার হয়েও তিনি বলেছিলেন, “ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, প্রতিহিংসা নয়, আসুন ভালোবাসা আর শান্তির সমাজ গড়ে তুলি। এই বিজয় আমাদের নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। তার এই বক্তব্য প্রমাণ করেছিল যে, বেগম জিয়া কেবল ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেননি, বরং তিনি ছিলেন প্রতিহিংসার ঊর্ধ্বে থাকা এক মহৎপ্রাণ নেত্রী।
বেগম খালেদা জিয়া কেবল বাংলাদেশের নেতাই ছিলেন না, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তিনি ছিলেন এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং আপোষহীন মনোভাবের জন্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম টাইম ম্যাগাজিন এবং দ্য নিউ ইউর্ক টাইমস তাকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এক অপরিহার্য শক্তি হিসেবে বর্ণনা করেছে। ২০১৮ সালে তার কারাদণ্ডের পর দ্য নিউ ইউর্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, “Khaleda Zia is the matriarch of the opposition.”
এছাড়াও বেগম জিয়ার উপর চলা নির্যাতনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো সর্বদা সোচ্চার ছিল। আওয়ামী লীগ আমলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, বেগম জিয়া রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার এবং তিনি ন্যায্য বিচার পাননি। ব্রিটিশ আইনজীবী ও তার আন্তর্জাতিক লিগ্যাল টিমের প্রধান লর্ড আলেকজান্ডার কার্লাইল বেগম জিয়ার মামলাগুলোকে ‘ভিত্তিহীন’ উল্লেখ করেছিলেন।
বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার এক আপোষহীন প্রতীক। তিনি আপোষ করে বিদেশে আয়েশী জীবন কাটাতে পারতেন, কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ।
আজ বেগম জিয়া নেই। কিন্তু তার রেখে যাওয়া ৫৪ বছরের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায় জ্বলজ্বল করছে। যে দেশের জন্য তিনি স্বামী হারিয়েছেন, যে দেশের জন্য তিনি সন্তানের পঙ্গুত্ব বরণ দেখেছেন, যে দেশের জন্য তিনি আরেক সন্তানের নিথর দেহ বুকে জড়িয়েছেন, সেই দেশের মানুষ আজ শোকে মুহ্যমান। নির্যাতন, জেল-জুলুম এবং মিথ্যাচার করে বেগম জিয়ার শরীরকে হয়তো দুর্বল করা গেছে, কিন্তু তার মেরুদণ্ড কিংবা মনোবল ভাঙা যায়নি। সব সময় বেগম খালেদা জিয়ার আদর্শ, দেশপ্রেম এবং ত্যাগের মহিমা মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায় । বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়া এক ধ্রুবতারা, যার আলো কোনদিন নিভবে না।