নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারই সংকট উত্তরনের একমাত্র উপায়

রবিবার, জুলাই ১৬, ২০২৩

 

নিজস্ব প্রতিবেদক।।
১৫ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবে সাবেক আমলাদের সংগঠন ‘পলিসি ম্যানেজমেন্ট এন্ড রিসার্চ সোসাইটি’ (পিএমআরএস) আয়োজিত “নির্দলীয় তত্ত্বাবদায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এবং বিদ্যমান সংকট উত্তরনের উপায়” শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে বক্তারা বর্তমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের একমাত্র উপায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনা মর্মে অভিমত পোষণ করেন।

সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং আইন অনুষদের প্রাক্তন ডীন ড. বোরহান উদ্দিন খান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিএমআরএস এর ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক যুগ্ম সচিব জনাব বিজন কান্তি সরকার। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক ইন্সেপেক্টর জেনারেল জনাব মো. আব্দুল কাইয়ুম, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সাবেক রেজিষ্টার জেনারেল জনাব ইকতেদার আহমেদ, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. মোহাম্মদ জকরিয়া, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান। এছাড়াও সেমিনারে অবসরপ্রাপ্ত শতাধিক সামরিক- বেসামরিক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় বক্তারা উল্লেখ করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল ১৯৯৬ সালে জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে রচিত একটি রাজনৈতিক সমঝোতার ফসল। দেশের সকল রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা- দাবী-আন্দোলন এবং সর্বোপরি জনগনের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলনই হচ্ছে “নির্দলীয় তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা। সেমিনারে কী-নোট পেপার উপস্থাপক জনাব বিজন কান্তি সরকার বলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক একটি বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের আদেশ প্রদান করে জাতিকে মহাসংকটে নিপতিত করেছে।

বিচারপতি খায়রুল হক বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা জনগনের ইচ্ছা এবং দেশের সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের ফসল হিসেবেই সংবিধানে স্থান পেয়েছিল। তিনি আরও বলেন, বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে ত্রয়োদশ সংশোধন আইন অবৈধ ঘোষণা এবং রায়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেশে চরম রাজনৈতিক সংকট তৈরী করা হয়েছে। সেমিনারে বক্তারা উল্লেখ করেন, দেশকে এ গভীর সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা, গণতন্ত্রে ফিরে আসা, প্রকৃত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা নিশ্চিত করা। আর এটা সম্ভব একটি ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার’ প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করার মাধ্যমে। বক্তারা আরও বলেন দলীয় সরকারের অধীন এদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের

ইতিহাস মোটেই সুখকর নয়। কারণ দেখা গেছে ১৯৭৩ সন হতে দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে
ইতিহাস মোটেই সুখকর নয়। কারণ দেখা গেছে ১৯৭৩ সন হতে দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা কখনও পরাজিত হয়নি।

অন্যদিকে নির্দলীয় তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত ১১/৯৬/২০০১ এর ৩ (তিন) টি নির্বাচন দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। জনগণ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছে, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করেছে।

আলোচকবৃন্দ বলেন, হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতি সমন্বয়ে গঠিত একটি (Full Bench) ত্রয়োদশ সংশোধন আইন তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বৈধ মর্মে ঘোষণা করেন। সুপ্রিম কোর্টে আপীলের শুনানীতেও ৮ জন এমিকাস কিউরির মধ্যে ৭ (সাত) জনই তত্ত্ববধায়ক সরকার প্রয়োজন মর্মে কোন না কোন ভাবে অভিমত প্রকাশ করেন।

রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা এটার্নি জেনারেল ও তাঁর সহযোগীগণও তত্ত্ববধায়ক সরকার প্রয়োজন মর্মে আদালতে তাদের যুক্তি তুলে ধরেন। প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এসকল অভিমত, যুক্তি, ব্যাখ্যা, পরামর্শ, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কোন কিছুই আমলে না নিয়ে একটি বিতর্কিত রায় প্রদান করে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে নিষ্পত্তিকৃত রাজনৈতিক বন্দোবস্তুকে রাতারাতি ওলট-পালট করে দেন। দেশ মহাসংকটে নিমজ্জিত হয়। এ বিতর্কিত রায়ের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তদানীন্তন এটার্নি জেনারেল বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধন আইন বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। তবে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় পরবর্তী দুটি নির্বাচন এ ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হবে।

জনাব ইকতেদার আহমেদ বলেন ১০/৫/২০১১ তারিখে প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত রায়ে (Short Order) চারজন বিচাপতি দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীন হতে পারে মর্মে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন এবং ৩ (তিন) জন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো ৭ (সাত) জন বিচারপতিই অন্তত দুই টার্ম অর্থাৎ দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে একমত ছিলেন। অথচ এ বিবেচনা উপেক্ষা করে ৩০ শে জুন ২০১১ তারিখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করায় এ বাতিল আদেশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। মূলত: এখান থেকেই সংকটের জন্ম। সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক বিষয় হলো ১০/০৫/২০১১ তারিখে প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত Short Order ১৬ মাস পরে অর্থাৎ ১৬/০৯/২০১২ তারিখে প্রকাশিত লিখিত রায়ে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়ার বিষয় থেকে সরে এসে সংসদের বিবেচনার (Discretion) উপর ছেড়ে দেন। যা ছিল Professional misconduct এবং Fraud on the court.

এখানে আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো, আদালত এখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের নির্দেশনা দেয়নি। আদালত Protectively শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ দুটি নির্বাচন (দশম ও একাদশ) এ ব্যবস্থায় হওয়ার পর বাতিল হবে। মর্মে আদেশ দিয়েছেন। অথচ আদালতের এ আদেশকে বিভ্রান্তিমূলকভাবে উপস্থাপন করে আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে জাতির সাথে প্রতারনা করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রত্যক্ষ প্রভাব জনগণ দেখতে পেয়েছে ২০১৪ ও ২০১৮ এর মতো নৈরাজ্যকর, প্রহসনমূলক ও মধ্যরাতের ভোটের মাধ্যমে যা জাতি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আর দেখতে চায় না।

সেমিনারে বক্তাগণ দেশের এই গভীর রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে ও জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার একমাত্র সমাধান হলো ‘নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা মর্মে অভিমত প্রকাশ করেন।