।। সাইদুর রহমান ।।
বর্তমানে আমাদের যাতায়াতের প্রধানতম মাধ্যম হলো সড়ক পরিবহন। কিন্তু এই সড়ক পরিবহন এখন পর্যন্ত আমাদের জন্য যথেষ্ট মাত্রায় নিরাপদ হয়ে ওঠেনি। সড়কে প্রতিদিন অসংখ্য দুর্ঘটনায় বহু মানুষ আহত-নিহত হচ্ছেন। আহতদের একটি বড় অংশ পঙ্গুত্ববরণ করে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন। দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের অধিকাংশই দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। দেশে আধুনিক-নিরাপদ যানবাহন সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী না হওয়ার কারণে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ভাঙাচোরা বাস, ট্রাক, পিকআপ, হিউম্যান হলার, থ্রি-হুইলার, নসিমন, ভটভটি, আলমসাধু, টমটম, মাহিন্দ্র ইত্যাদি অনিরাপদ যানবাহনে যাতায়াত করছেন। এতে করে হরহামেশা মানুষ দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া পায়ে হেঁটে পথ চলার সময় নিজেদের অসচেতনতা এবং যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণে অনেক পথচারী আহত-নিহত হচ্ছেন। ইদানিং এটা বেড়েছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের ১৬ থেকে ১৮ শতাংশই পথচারী। পথচারী নিহতের ক্ষেত্রে ৬২ শতাংশ দায়ী যানবাহনের বেপরোয়া গতি এবং ৫৮ শতাংশ দায়ী পথচারীদের অসচেতনতা।
সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ৮২ শতাংশই কর্মক্ষম মানুষ, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৬৫ বছর এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্তরা তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর কারণে পরিবারের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে এবং দুর্ঘটনায় আহত সদস্যকে সহায়-সম্পদ বিক্রি করে চিকিৎসা করতে যেয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সর্বশান্ত হচ্ছে। ফলে অসংখ্য পরিবার সামাজিক অর্থনীতির মূল স্রোত থেকে হারিয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। চিকিৎসার পরেও যারা পঙ্গু হচ্ছেন তাদের অবস্থা আরও করুণ! মোটকথা, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থাসম্পন্ন পবিারগুলো আর্থিকভাবে টিকে থাকতে পারলেও নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারগুলো পারছে না। এভাবেই দেশে আর্থ-সমাজিক সংকট তীব্র হচ্ছে। দেশে নানা ক্ষেত্রের চাকচিক্যের আড়ালে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ ক্ষত নিয়ে কত মানুষ যে যন্ত্রণাকাতর জীবনযাপন করছেন তার হিসাব নেই!
সড়ক দুর্ঘটনা পরবর্তীতে বা চিকিৎসাধীন অবস্থায় বহু মানুষের মৃত্যু কমানো সম্ভব, যদি আহত ব্যক্তিকে সঠিক সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা দেয়া যায়। চিকিৎসকদের মতে, দুর্ঘটনা পরবর্তী ৬ ঘন্টা হলো গোল্ডেন আওয়ার। এই সময়ের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদান করতে পারলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার অনেকখানি কমানো সম্ভব। পঙ্গুত্ববরণও কমে। কিন্তু দুঃখজনক যে, দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতদের অধিকাংশকেই গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হয় না প্রধানত দু’টি কারণে। এক. পারিবারিক আর্থিক সংকট, দুই. উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় এবং পর্যাপ্ত আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা না থাকা। জেলা সদর হাসপাতালে গুরুতর আহত রোগী নিয়ে গেলেই চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতদের অধিকাংশই দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির হওয়ায় তারা অর্থের অভাবে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়াসহ আনুসঙ্গিক চিকিৎসা খরচ যোগাড় করে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় চিকিৎসা করাতে পারেন না। সহায়-সম্বল বিক্রি করে, ধার-দেনা করে ঢাকার আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি হতে অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার কারণে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এছাড়া ভর্তি হওয়ার পর হাসপাতালে সিট না থাকা, আইসিইউ সুবিধা না পাওয়া ইত্যাদি কারণেও অনেক রোগী মারা যায়। চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল ফেনির সদর উপজেলায় ৩৮ বছর বয়সী হতদরিদ্র ইলেক্ট্রিশিয়ান মোঃ শাহীন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে আহত হলে তার স্বজনরা চাঁদা তুলে তাকে ফেনি সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে আইসিইউ সুবিধার জন্য তারা অ্যাম্বুলেন্সে চট্টগ্রামে এবং ঢাকায় ২দিন ঘুরেও কোনো সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি করতে না পেরে ফেনিতে ফিরে যান এবং শাহীনের মৃত্যু হয়। চট্টগ্রাম ও ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা থাকলেও তারা টাকার অভাবে শাহীনকে ভর্তি করতে পারেননি। এমন নির্মম ঘটনা প্রায়শ ঘটে, যা গণমাধ্যমে আসে না। উল্লেখ্য, সময় ক্ষেপণের কারণে আরোগ্য সম্ভব এমন অনেক আহত মানুষ পঙ্গু হয়ে যায়। এসব পঙ্গু মানুষের অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তির মতো অভিশপ্ত জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন। অথচ তারা দুর্ঘটনার পূর্বে নানা প্রকার কাজ করে মোটামুটি স্বচ্ছল জীবনযাপন করতেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের একটি গবেষণা জরিপে দেখা যায়, দেশের পঙ্গু ভিক্ষুকদের ৮৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হওয়া মানুষ। চক্ষু লজ্জার কারণে যারা এই পর্যায়ে আসেন না, তাদের দুর্ভোগ এসব ভিক্ষুকের চেয়ে কম নয়। এই যে মানব সম্পদের বিপুল অপচয়, জনশক্তির বিরাট ক্ষতি- এদিকে কারো নজর নেই। পূর্বের আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের যে সুযোগ-সুবিধা ছিল, তা কখনোই ক্ষতিগ্রস্তরা পাননি। তারা জানতেই পারেননি তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা আছে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে অনিবার্য হয়ে উঠেছে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারের চরম দুর্গতি।
পূর্বের আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা ছিল সেদিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক। দেখে নেয়া যাক, সেসব বিধি-বিধান থেকে ক্ষতিগ্রস্তরা আদৌ উপকৃত হয়েছেন কী না। আমাদের দেশে মোটরযান অর্ডিন্যান্স এ্যাক্ট-১৯৮৩ তে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সকল ধরনের মোটরযানে “তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকি বীমা” বাধ্যতামূলক ছিল। এই বীমার আওতায় বীমা কোম্পানীগুলো প্রতিটি মোটরযান থেকে ঝুঁকি বীমা হিসেবে নিয়মিত প্রিমিয়াম নিয়েছে। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ সেই ঝুঁকি বীমা থেকে ক্ষতিপূরণ (বীমা সুবিধা) পেয়েছেন এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! উক্ত আইনে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালত ছিল ক্লেইম ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু এই ক্লেইম ট্রাইব্যুনালে ক্ষতিপূরণের জন্য কেউ মামলা করেছেন, আবেদন করেছেন- এমন নজিরও তেমন নেই। কারণ ক্ষতিগ্রস্তরা জানতেই পারেননি তাদের জন্য ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আইনি প্রতিষ্ঠান আছে। রাষ্ট্রও প্রচারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে জানায়নি। অথচ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের জন্য মোটরযানে তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকি বীমা না থাকলে পুলিশ মামলা করেছে। মোটরসাইকেলে পাঁচশত টাকার বীমা হালনাগাদ না থাকার কারণে পুলিশ দুই হাজার টাকার মামলা দিয়েছে, জরিমানা করেছে।
এখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বীমা কোম্পানীগুলো এই দীর্ঘ সময় ধরে তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকি বীমার যে প্রিমিয়াম নিল, অথচ ক্ষতিগ্রস্তদের বীমা সুবিধা দিল না, তাহলে এই বীমার টাকা গেল কোথায়? কারা নিল? এই প্রশ্নের উত্তর জানার অধিকার নিশ্চয়ই দেশের মানুষের আছে বৈকি! মূলত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বীমা কোম্পানীগুলোকে এই অনৈতিক সুবিধা দিয়েছে। তারা কখনোই বীমা কোম্পানীর মাধ্যমে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করেননি। কোম্পানীগুলোও আগ্রহ দেখায়নি। দুঃখজনক যে, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি পূরণের দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্র সবসময় সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে এবং এখনো যাচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির নিহতের ঘটনা বা কোনো সাধারণ মানুষের নিহতের ঘটনা যখনই ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে, তখনই আদালত ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য যানবাহনের মালিককে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সেই নির্দেশ আইনি মারপ্যাচে আটকে গিয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ পাননি।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে নিরাপদ সড়কের দাবিতে সংঘটিত কিশোর-ছাত্রদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ প্রণয়ন করে। আইনটির অধিকাংশ ধারা ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর হতে অফিসিয়ালি কার্যকর হয়েছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে এই আইন কার্যকরের তেমন কোনো দৃশ্যমান প্রভাব নেই।
উল্লেখ্য, যেহেতু পূর্বের আইনে থাকা তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকি বীমার মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা বীমা সুবিধা পাননি, এই অজুহাতে বর্তমান আইনে মোটরযানের তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকি বীমার বিধান উঠিয়ে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য “ট্রাস্ট ফান্ড- এর বিধান রাখা হয়েছে। ২০১৮ সালে আইনটি প্রণয়ন হলেও ট্রাস্ট ফান্ড সম্পর্কিত বিধি তৈরি হয়েছে ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর। দীর্ঘদিন পর এই ট্রাস্ট ফান্ড আইন হিসেবে কার্যকর হয়েছে। যদিও এই ফান্ডের মাধ্যমে অদ্যাবধি কোনো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ক্ষতিপূরণ পাননি।
এই ট্রাস্ট ফান্ডের গঠন কাঠামোতে বলা হয়েছে, বিআরটিএ’র চেয়ারম্যানকে প্রধান করে ১২ সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিচালনা বোর্ড থাকবে। প্রতি তিনমাস অন্তর বোর্ডের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ফান্ডের অর্থের উৎস হিসেবে বলা হয়েছে, প্রতিবছর বাস-ট্রাক-কাভার্ডভ্যান থেকে ১৫০০ টাকা, মোটরসাইকেল থেকে ১০০০ টাকা, মিনিবাস-পিকআপ ভ্যান থেকে ৭৫০ টাকা, প্রাইভেটকার-জীপ থেকে ৫০০ টাকা এবং থ্রি-হুইলার থেকে ৩৫০ টাকা নেয়া হবে। মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন ফি, নবায়ন ফি, বিভিন্ন প্রকার চাঁদা ও অনুদান হবে এই তহবিলের উৎস। ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়া হবে- দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ৫ লাখ টাকা, অঙ্গহানি হলে ৩ লাখ টাকা এবং সুস্থ জীবনে ফেরার সম্ভাবনা না থাকলে ১ লাখ টাকা দেওয়া হবে। ক্ষতিপূরণ পেতে হলে দুর্ঘটনা ঘটার ৩০ দিনের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ড বরাবর আবেদন করতে হবে। আবেদন প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিবেন। প্রতিবেদন জমা হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন মঞ্জুর পূর্বক ব্যাংক চেকের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদান করা হবে।
ট্রাস্ট ফান্ডের যে সাংগঠনিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনা, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এবং প্রদানের যে পদ্ধতি, তাতে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের পক্ষে এই ফান্ড থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়া শুধু সময় সাপেক্ষই হবে না, এক প্রকার দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে। বহু ভোগান্তি সয়ে কিছু পেলেও সেটা হবে খুবই অপ্রতুল। ট্রাস্ট ফান্ড থেকে সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি হবে। আবেদন করা, পুলিশি তদন্ত ও প্রতিবেদন জমা হওয়া, এরপর যাচাই-বাছাই ইত্যাদি করতেই অনেক সময় কেটে যাবে। উল্লিখিত সময়ের মধ্যে কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে- এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ আছে বলে মনে করি না। কারণ আমাদের দেশের কোনো দপ্তরেই নিয়ম অনুযায়ী কাজ হয় না। প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চল থেকে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্র মানুষের পক্ষে আবেদন করা, ঢাকার অফিসে খোঁজ-খবর করে কাজটিকে এগিয়ে নেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য হবে। ক্ষতিপূরণ প্রদান বিষয়ে পুলিশি তদন্তে নানা প্রকার সমস্যা তৈরি হবে। ধরুন, দিনাজপুরের একজন দরিদ্র মানুষ কুমিল্লায় দুর্ঘটনায় নিহত হলেন। এখানে পুলিশকে দুই জায়গায় তদন্ত করতে হবে। দুর্ঘটনার স্থান, সময়, দুর্ঘটনার কারণ, আক্রান্তের স্থায়ী ঠিকানা ও ওয়ারিশ- এসব বিষয়ে ব্যাপক জটিলতা তৈরি হওয়ার আশংকা রয়েছে। অথচ সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন চিকিৎসা। এজন্য তাৎক্ষণিক অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু এই ট্রাস্ট ফান্ড তাৎক্ষণিক তো নয়-ই, তিন মাসের মধ্যেও চিকিৎসাসেবায় কোনো প্রকার অবদান রাখতে পারবে না।
এই বাস্তবতায় সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ভিন্নতর ব্যবস্থা “ইন্ডিপেনডেন্ট ফান্ড” গঠনের বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। একটি দুর্ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে; ঢাকা থেকে বহুদূরের প্রত্যন্ত গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারের সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছে। স্থানীয় হাসপাতাল বা জেলা সদরের হাসপাতাল তাকে ঢাকায় রেফার্ড করে দিয়েছে। কিন্তু পরিবারটির হাতে কোনো টাকা নেই। টাকা যোগাড় করতে হলে ভিটে-বাড়ি বিক্রি করতে হবে। এই অবস্থায় সেই পরিবার কী করবে? কোথায় পাবে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়াসহ চিকিৎসার আনুসঙ্গিক খরচ? এই বিষয়টি কি আমরা কখনো ভেবেছি? না ভাবিনি। কারণ আমরা নিজে বিপদগ্রস্ত না হওয়া পর্যন্ত মানুষের কষ্টকে জীবন দিয়ে অনুভব করি না। এই বোধটিই আমাদের মধ্যে তৈরি হয়নি। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার সাথে সাথে সর্বাগ্রে প্রয়োজন আহত ব্যক্তির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং এজন্য তাৎক্ষণিকভাবে অর্থের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমরা যদি সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা ফ্রি করতে পারি, তাহলে এটাই হবে সবচেয়ে টেকসই ও মানবিক কাজ, যা সহজেই করা সম্ভব। এজন্য একটি সাহসী পরিকল্পনা গ্রহণ করে সড়ক পরিবহন আইনে বিদ্যমান “ট্রাস্ট ফান্ড”বিলুপ্ত করে “ইন্ডিপেনডেন্ট ফান্ড”তৈরি করা যেতে পারে। এই ফান্ডে প্রতিবছর সর্বোচ্চ ৩ (তিন) হাজার কোটি টাকা হলেই দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সকলের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সম্ভব। যেসব উৎস থেকে ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থ সংগ্রহ করা হবে; সেসব উৎস-সহ পুলিশ কর্তৃক মোটরযান থেকে জরিমানার অর্থের একটি অংশ, বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সিএসআর ও অনুদান থেকে এই পরিমাণ অর্থ খুব সহজেই সংগ্রহ করা সম্ভব।
এই ফান্ড গঠিত হলে- যে কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার সাথে সাথে তাকে নিকটবর্তী বা প্রয়োজন অনুযায়ী উন্নত হাসপাতালে চিকিৎসা করা সম্ভব হবে আহত ব্যক্তির পারিবারিক অর্থ ছাড়াই। এক্ষেত্রে রোগীর জন্য একটি মেডিকেল কোড নম্বর ব্যবহার করতে হবে। পরবর্তীতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা খরচ রোগীর মেডিকেল কোডের বিপরীতে ইন্ডিপেনডেন্ট ফান্ড থেকে গ্রহণ করবে। এই কার্যক্রম যথাযথ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিমুক্তভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্তিশালী মাল্টি সেক্টরাল কেন্দ্রীয় কমিটি থাকতে হবে। সিভিল প্রশাসন, পুলিশ, চিকিৎসক, সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি, সড়ক নিরাপত্তায় কাজ করা সংস্থাসমূহের প্রতিনিধি ইত্যাদির সমন্বয়ে এই কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটির সাংগঠনিক কাঠামো জেলা-উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত থাকতে হবে। এসব কমিটিতে স্থানীয় সিভিল প্রশাসন, পুলিশ, চিকিৎসক, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, রোড সেফটি প্রফেশনাল, আইনজীবী, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি, সড়ক নিরাপত্তায় কাজ করা সংস্থাসমূহের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কমিটির সদস্য সংখ্যা অধিক হলে সহজে দুর্নীতি করা যায় না। এতে করে সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবার সহজে চিকিৎসা সেবা এবং ক্ষতিপূরণ পাবেন। সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য সকল জেলা সদর হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে নিউরো সার্জারী বিভাগ উন্নত করতে হবে। কারণ সড়ক দুর্ঘটনায় হেড ইনজুরি বেশি হয় এবং হেড ইনজুরির কারণেই অধিকাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
এসব বিবেচনায় বর্তমান সড়ক পরিবহন আইনে বিদ্যমান ট্রাস্ট ফান্ডের পরিবর্তে “ইন্ডিপেনডেন্ট ফান্ড” গঠন করা জরুরি। একই সাথে মোটরযানে “তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকি বীমা” প্রবর্তন করতে হবে। প্রয়োজনে প্রিমিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বীমা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এই বীমা ব্যবস্থা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই আছে। কার্যকর টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ করে যেকোনো মূল্যে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলে ফান্ডের প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ যেমন কমবে, তেমনি মানুষের দুর্দশাও কমবে। যেহেতু সড়ক পরিবহন খাতের অব্যবস্থাপনার কারণেই অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, তাই এসব দুর্ঘটনায় আহত-নিহতের দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এটা নৈতিকতার প্রশ্ন। উল্লিখিত ইন্ডিপেনডেন্ট ফান্ড’কে জনবান্ধব করার জন্য এর গঠন কাঠামো এবং পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই এটার প্রয়োজনীয়তাকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ সড়ক দুর্ঘটনার অভিঘাতে সাধারণ মানুষ খুব কষ্টে আছে।
লেখক: সাইদুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক- রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।