জাতির সংবাদ ডটকম।।
অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় ডুবছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা। এতিমদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে তত্ত্বাবধায়ক ও পরিচালনা কমিটির একটি অংশ মিলে গঠিত চক্র লুট করছে প্রতিষ্ঠানের অর্থ- এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। চক্রের দৌরাত্ম্য থামাতে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হলেও তিনি টিকতে পারেননি বেশি দিওয়া দিন।
প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ নিয়োগ, এতিহ্যবাহী গাছ বিক্রি এবং গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজ করার অভিযোগের তদন্ত করে সমাজসেবা অধিদপ্তর তাদের প্রতিবেদনে এই এতিমখানায় প্রশাসক নিয়োগের সপারিশ করেছিল। প্রতিবেদনটিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তত্ত্বাবধায়ক হরুন অর রশিদ উষ্মা প্রকাশ করেন- একজন সরকারি কর্মকর্তা তার চেয়ার ব্যবহার করে একটা কিছু লিখে দিলে সেটা আইন হয়ে গেল না।
নানা অপরাধ ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থেকেও এতিমখানায় তত্ত্বাবধায়কের পদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন হারুন। একই সঙ্গে রয়ে গেছে আওয়ামী সিন্ডিকেট। তারা নানা কৌশলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখছে এতিমখানাটি।
জানা যায়, স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানায় লালিত-পালিত হন তত্ত্বাবধায়ক হারুন। এতিমখানায় বড় হওয়ায় এখানকার সবই ছিল তার নখদর্পণে। ছাত্র থাকাকালেই বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং কমিটিকে ম্যানেজ করে ২০২০ সালে এতিমখানায় অস্থায়ী পদে শারীরিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান হারুন অর রশিদ। চাকরি পেয়েই গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। এতিমখানার স্বার্থবিরোধী কাজ করার অপরাধে ওই বছরই হারুনসহ পাঁচজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় মামলা করেন এতিমখানার তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মামুন। মামলা নম্বর ৩৫ (১১) ২০২০। মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন।
চাকরিচ্যুত হলেও এতিমখানা ছাড়েননি হারুন। ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকা জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর ১৪ সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয়। অর্থের বিনিময়ে এই কমিটির একটি অংশকে নিজের পক্ষে নেন তিনি। কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাব্বির আহমেদ, সহ-সভাপতি সুমি আলম, কোষাধ্যক্ষ শহীদুল ইসলাম, কমিটির সদস্য এবং গোপালগঞ্জ যুব মহিলা লীগের সভাপতি পর্শিয়া সুলতানা, ওলামা লীগ নেতা সাগর আহমেদ শাহিন, সদস্য মোহাম্মদ আলী সোহেল এবং উপদেষ্টা কমিটির সদস্য শাখাওয়াত আলী জুয়েলসহ কয়েকজনকে নিয়ে এতিমখানায় আওয়ামী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন হারুন।
কমিটির সভাপতি আব্দুস শুকুর ইমন, সহ-সভাপতি আবু নাসের ইকবালসহ কয়েকজনকে এতিমখানায় প্রবেশ একরকম নিষিদ্ধ করে হারুন সিন্ডিকেট। সব কাজ থেকে তাদের বিরত রাখে তারা। প্রতিষ্ঠানের সব সিদ্ধান্ত নিতেন এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। আর হারুন তা বাস্তবায়ন করতেন।
আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় অর্থের বিনিময়ে হারুনসহ পাঁচজনকে চাকরি ফিরিয়ে দেয় আওয়ামী সিন্ডিকেট। চাকরি ফেরত পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন হারুন। একে একে সব প্রতিপক্ষকে প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে দেন। সিন্ডিকেট ম্যানেজ করে তত্ত্বাবধায়ক পদও দখলে নেন তিনি। এরপর হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নূরসাত আলমকে চাকরিচ্যুত করেন। অবৈধ পন্থায় বিভিন্ন পদে ১৬ জনকে নিয়োগ দেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে অনাথ শিশুর চেয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। এতিমখানার বার্ষিক আয়ের ২৫ ভাগের বেশি অর্থ ব্যয় হ বেতন- ভাতার জন্য।
হারুনের যোগসাজশে এই কমিটি বিভিন্ন খাতে লাখ লাখ টাকা এতিমখানার ফান্ড থেকে আত্মসাৎ করেন বলে তথ্য এসেছে ঢাকাটাইমসের কাছে।
তারা বিভিন্ন জনের আপত্তি উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্যবাহী ২৬টি গাছ বিক্রি করে দেয়, কিন্তু এক টাকাও এতিমখানার ফান্ডে জমা দেয়নি। এতিমখানা সংস্কারের কথা বলে বিভিন্ন সময় অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলন করে তা আত্মসাৎ করা হয়। হারুনসহ পাঁচজনকে চাকরিতে পুনর্বহালের পর তাদের বকেয়া বেতনের কথা বলে এতিমখানার ফান্ড থেকে ২৫ লাখ টাকা তুলে নেয় সিন্ডিকেট। এ ছাড়া এতিমখানার একটি দেয়াল নির্মাণের কথা বলে ২৫ লাখ টাকা তুলে আত্মসাৎ করে। তত্ত্বাবধায়কের বাসা মেরামতের জন্য নেয় ৭ লাখ টাকা। হাইকোর্টের আদেশে পাওয়া কনকর্ডের নির্মাণাধীন ভবনের মালামালও লুট করে এই চক্রের সদস্যরা।
জানা গেছে, এতিমখানার অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ২৬ মে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় লিখিত অভিযোগ দেন তৎকালীন সভাপতি আব্দুস শুকুর ইমন। অভিযোগের ভিত্তিতে দীর্ঘদিন তদন্ত ব্যার গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন = টাইলস= দেয় সমাজসেবা অধিদপ্তর। প্রতিবে নে এতিমখাব সম্পদ বক্ষা ও নিবাসীদের সর্বোচ্চ সে নেওয়ার সাধারি নিয়োগেরও সুপারিশ করা হয় রি বাপির উদ্যোগ প্রশাসক তদন্ত কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) সমীর মল্লিককে গত ৮ অক্টোবর এতিমখানায় প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে তিনি সেখানে বেশিদিন টিকতে পারেননি।
সমীর মল্লিক বলেন, ‘এতিমখানার প্রশাসকের পদ থেকে আমি রিজাইন দিয়েছি। একজন প্রশাসক দিয়ে কাজ হবে না, সেখানে আরও কয়েকজনকে লাগবে। পুনরায় এতিমখানায় নতুন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে।’ এতিমখানা নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত ১৪ অক্টোবর নতুন পরিচালনায় নতুন কমিটি করে হারুন ও তার সিন্ডিকেটের লোকজন। এই কমিটির অনুমোদন দেয়নি ঢাকা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়।
এই এতিমখানায় লুটপাট ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয় সমাজসেবার প্রতিবেদনে। সব অভিযোগের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক হারুন অর রশিদের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি।
কিন্তু নানা অপরাধ ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থেকেও এতিমখানায় তত্ত্বাবধায়কের পদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন হারুন। তার ভয়ে তটস্থ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা- কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা। কেউ মুখ খুলতে রাজি হয় না।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এতিমখানার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এতিমখানায় হারুন একটি ত্রাসের নাম। ছাত্র থাকাবস্থায় তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। খোঁজ নিলেই দেখবেন তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ হয়েছে। আমি আর কিছু বলতে চাই না।’
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতারও অভিযোগ রয়েছে হারুণের বিরুদ্ধে। তার বেপরোয়া আচরণের পেছনে এটিও শক্তি জুগিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। নৌকার পক্ষেও প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা গেছে হারুনকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারের ব্যানারেও তার ছবি রয়েছে।
বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হারুন অর রশিদ সেসব অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘অভিযোগ ও তদন্ত রিপোর্ট সম্পর্কে কিছুই জানি না। তদন্ত কর্মকর্তারা আমাকে কিছু জানাননি। শারীরিক শিক্ষক থেকে কয়েক দিন সহকারী তত্ত্বাবধায়ক ছিলাম, এরপর কমিটি আমাকে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয়। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার জন্য আমাকে এ পদে নিয়োগ দেয় কমিটি।’
এতিমখানা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রশাসক নিয়োগের সুপারিশসংবলিত সমাজসেবার প্রতিবেদনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন তত্ত্বাবধায়ক হরুন অর রশিদ। তিনি বলেন, ‘সমাজসেবা একটা রিপোর্ট দিয়েছে। এটা কোনো আল কোরআনের আয়াত নয়। একজন সরকারি কর্মকর্তা তার চেয়ারকে ব্যবহার করে একটা লেখা লিখে দিলে সেটা তো আর আইন হয়ে গেল না।’
আওয়ামী লীগের প্রচারণায় তার উপস্থিতির বিষয়ে হারুন বলেন, ‘ব্যানারে জোর করে আমার ছবি লাগিয়ে দিয়েছে। দেখেন আওয়ামী লীগে আমার কোনো পদ আছে কি না।’
তবে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ছবিতে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে দেখা গেছে হারুনকে।
২০২২-২৪ সালের কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘এতিমখানার অনেক কিছুই প্রশ্নবিদ্ধ। সামনাসামনি আসেন কথা বলব। সমাজসেবা অধিদপ্তরের কোনো তদন্ত প্রতিবেদন অফিসিয়ালি আমার কাছে আসেনি। তবে তদন্ত চলাকালীন আমরা সমাজসেবা অধিদপ্তরকে কাগজপত্র দিয়ে সহায়তা করেছি।’ সামনাসামনি কথা বলতে চাইলে পরে তিনি আর আগ্রহ দেখাননি। সূত্র-ঢাকা টাইমস